২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে, দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ৬৪%, কিন্তু আদিবাসী মহিলাদের সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ৪২%। আর শিক্ষাক্ষেত্রে সমগ্র দেশে স্নাতক ৯% এর কাছাকাছি হলেও আদিবাসী মহিলাদের মধ্যে ৩% এরও কম। আবার স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে শিশুমৃত্যুর হার বা শিশুকন্যার অপুষ্টি, কিংবা রক্তাল্পতায় আক্রান্ত নারীর কথাই বলুন, দেশে আদিবাসী নারীদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। তাই আদিবাসী মহিলা রাষ্ট্রপতি হলেই কি সব পাল্টে যাবে? এ নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন যোগেন্দ্র যাদব। আজ প্রথম কিস্তি।
আমি তাঁকে বললাম, অভিনন্দন! শ্রীমতি দ্রৌপদী মুর্মু দেশের রাষ্ট্রপতি হতে চলেছেন। তাঁর চোখ-মুখ দেখেই আমি স্পষ্ট করে বললাম যে তিনি এখনো রাষ্ট্রপতি হননি, হতে চলেছেন। ভোট-গণনার আনুষ্ঠানিকতা বাকি থাকলেও ফলাফল নিয়ে কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই। তখন উনি বললেন, এটা ফলাফলের বিষয়ই নয়। কাউকে না কাউকে তো রাষ্ট্রপতি হতে হবে। এতে আবার আলাদা করে ভাবার কী আছে? আমি বললাম, আলাদা করে ভাবার ব্যাপার তো আছেই। প্রথমবারের মতো আদিবাসী সমাজের একজন প্রতিনিধি দেশের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন, তাও আবার একজন নারী! এবার প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে সাব-জেনারেল এবং সেনারা এক আদিবাসী মহিলাকে স্যালুট করবেন। আপনি গর্বিত নাই হতে পারেন, আমি কিন্তু এতে ভীষণই গর্বিত। একবার ভাবুন, টিভিতে এই মহিলাকে দেখে কত মহিলা অনুপ্রেরণা পাবেন। ইনি তাঁদের শক্তির অন্যতম মাধ্যম হবেন। তাঁর চোখে মুখে কোনোও রকম উত্তেজনা দেখলাম না। বললেন, এর আগেও তো একজন মহিলা এই দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। একজন আদিবাসী নারী হওয়ার মধ্যে কী এমন বিশেষত্ব আছে? এই প্রশ্নের জন্য আমি আঁটঘাট বেঁধেই তৈরি ছিলাম। বললাম, ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে, দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ৬৪%, কিন্তু আদিবাসী মহিলাদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ৪২%... আর স্নাতকদের কথা বললে তো, সমগ্র দেশে স্নাতক ৯% এর কাছাকাছি হলেও আদিবাসী মহিলাদের মধ্যে ৩% এরও কম। আবার আপনি স্বাস্থ্যের যে কোনো মাপকাঠি দেখে নিন, সে শিশুমৃত্যুর হারই বলুন বা কন্যাশিশুর অপুষ্টিই বলুন কিংবা রক্তাল্পতায় আক্রান্ত নারীর কথাই বলুন, দেশে আদিবাসী নারীদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। এদেশে সর্বশেষ কোনোও মানুষ যদি থেকে থাকেন তা’হলে, তিনি অবশ্যই একজন আদিবাসী মহিলা।
উনি চুপ করে গেলেন। ওঁর নীরবতা আমায় সাহস দিল। আমি আলোচনাটাকে এগিয়ে নিয়ে গেলাম। দ্রৌপদী মুর্মুর রাষ্ট্রপতি হওয়া এদেশের শেষ প্রান্তে বসে থাকা ৬ কোটি আদিবাসী নারীর সম্মান বলে আমি মনে করি। ওঁর সাথে দেখা করার সৌভাগ্য তো কখনো হয়নি আমার। তবে আমি ওঁর সম্পর্কে যতটুকু পড়েছি, তা থেকে এটা ভীষণ স্পষ্ট যে উনি একজন বিচক্ষণ মহিলা। গ্রামের প্রথম স্নাতক হওয়া থেকে শুরু করে কঠিন পরিস্থিতিতেও শিক্ষা অর্জনের যে বিভৎস চাহিদা, আর তারপর সমাজসেবা করার জন্য ফিরে আসা এবং ব্যক্তিগত সমস্ত আঘাতকে উপেক্ষা করে জনজীবনের মাঝে নিজেকে সম্পূর্ণ উজাড় করে দেওয়া পর্যন্ত ওঁর এই চলার পথ মোটেই সহজ ছিলনা। রাজ্যপালের মতো ক্ষমতাশালী পদে থাকার পরেও তিনি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। দ্রৌপদী মুর্মু, ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল হওয়ার সুবাদে, সমস্ত কস্তুরবা গান্ধী বালিকা বিদ্যালয় পরিদর্শন করেছিলেন, যে স্কুলগুলো দলিত, আদিবাসী এবং অন্যান্য তথাকথিতভাবে পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায়ের মেয়েদের জন্য বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত। আর এই সব কিছু মোটেই তুচ্ছ করার মতো বিষয় নয়। উনি মন দিয়ে শুনলেন বটে কিন্তু ওঁর চোখ-মুখের ভাব বদলালো না একটুও। কিছুক্ষণ পর বললেন: রাষ্ট্রপতি তো রাবারের সিলমোহর ছাড়া আর কিছুই নয়। ওই চেয়ারটায় কেউ বসলে তাঁর সমাজের মানুষের জীবনে কী পার্থক্য আসবে? মনে নেই! যখন এদেশে শিখদের গণহত্যা হয়েছিল, সেই সময়ে এদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন জিয়ানি জৈল সিং। গুজরাত দাঙ্গার পরে আবদুল কালাম এদেশের রাষ্ট্রপতি হন। তার ফলে দাঙ্গায় যারা পীড়িত ছিলেন তাঁদের প্রতি কি সত্যিই ন্যায় বিচার হয়েছে? রামনাথ কোবিন্দের রাষ্ট্রপতি আমলে দলিতদের উপর অত্যাচারের বহু ঘটনাই তো ঘটল। তাতে কী এসে গেল?
লেখক: ‘স্বরাজ ইন্ডিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা।
অনুবাদ: প্রতীক্ষা ঘোষ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct