স্মৃতিপটে অধ্যাপক প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ
তুহিন সাজ্জাদ সেখ
যুবক ভারতবর্ষ” বা “ইয়ং ইন্ডিয়া” কথাটা আজকাল প্রায়ই শোনা যায়, অর্থাৎ ভারতবর্ষের মোট জনসংখ্যার নাকি পঞ্চাশ শতাংশই পঁচিশ বছরের নিচে বয়স এবং প্রায় পঁয়ষট্টি শতাংশ মানুষ পঁয়ত্রিশ বছরের নিচে। মজার বিষয়, এই তথ্য টি পেতে সাহায্য করেছে “পরিসংখ্যান” বা “স্ট্যটিস্টিক্স” । আবার এ কথা অনুমান করা হচ্ছে যে ২০২৫ খ্রীস্টাব্দে সকল ভারতীয়র গড় বয়স হবে নাকি ত্রিশ বছর, যেখানে চীনদেশের লোকেদের গড় বয়স সাঁইত্রিশ বছর এবং জাপানের ক্ষেত্রে সেটা আটচল্লিশ বছরের কাছাকাছি। এই বিযষয়টির সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্য তুলে দিতেও সাহায্য করবে এই “পরিসংখ্যান” । শুধু তাই নয় “পরিসংখ্যান” বা “স্ট্যাটিস্টিক্স” বিভিন্ন ধরনের তথ্যের সাংখ্যিক রূপ দিতে ব্যাপকভাবে সাহায্য করে। কোন দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে “পরিসংখ্যান”- এর ভূমিকা অনবদ্য। এসব কথা মাথায় রেখেই ভারতবর্ষে ২৯শে জুন দিনটি উদযাপিত হয় “জাতীয় পরিসংখ্যান দিবস” হিসেবে।“পরিসংখ্যান” বা “স্ট্যাটিস্টিক্স” শব্দটি আক্ষরিক ভাবে দুটি অর্থ বহন করে--- একটি বহুবচনে তো অন্যটি একবচনে। বহুবচনে “পরিসংখ্যান” বলতে সাংখ্যিক রূপে সমষ্টিকৃত একগুচ্ছ তথ্যকে নির্দেশ করে এবং একবচনে এটি একটি বিশেষ বিজ্ঞান যেখানে প্রদত্ত রাশিগুচ্ছের সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও তাৎপর্য অনুধাবনের মাধ্যমে কোন একটি বিষয় সমূহের উপর সম্ভাবনা তত্ত্বের সাহায্যে ভাবীকথন উপস্থাপন করে। “স্ট্যাটিস্টিক্স” একটি ইংরেজি শব্দ--- প্রাচীন কালে একে বলা হতো “রাজ্যের বিজ্ঞান”(সায়েন্স অব স্টেট ) বা “রাজার বিজ্ঞান”( সায়েন্স অব কিং ) , যেহেতু এই বিষয়টি সচরাচর কোন রাজ্য শাসনে বা রাজা মহাশয়রা ব্যবহার করতেন, তাঁদের কর্মক্ষেত্রে। এই শব্দটি ল্যাটিন শব্দ “স্ট্যাটাস” বা ইতালীয় শব্দ “স্ট্যাটাস্টা” কিংবা জার্মান শব্দ “স্ট্যাটাস্টিক” থেকে আগত।১৭৯১ খ্রীস্টাব্দে “স্ট্যাটিস্টিক্স” এই ইংরাজি শব্দটিকে স্যার জন সিনক্লেয়ার উদ্ভাবন করেন তাঁর “স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব স্কটল্যান্ড “ নামক বইতে। তবে জানা গেছে আরও বহু পূর্বে ১৬০২ খ্রীষ্টাব্দে উইলিয়াম সেক্সপীয়ার তাঁর বিখ্যাত ‘হ্যামলেট’ নাটকে “স্ট্যাটিস্ট” বলে একটি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন, পরিস্থিতি বোঝাতে। গবেষণায় উঠে এসেছে, “স্ট্যাটিস্টিক্স” এর জন্ম হয়েছিল প্রায় ১৬৬২ খ্রীষ্টাব্দে যখন জন গ্রান্ট এবং উইলিয়াম পেটী একত্রে মানব পরিসংখ্যান ও জনগণনার সূচনা করেছিলেন।--- যা আধুনিক জনসংখ্যা তত্ত্বের উৎস হিসেবে মনে করা হয়।
পরিসংখ্যান বিদ্যা তথ্যের বিচার বিশ্লেষণ পূর্বক সম্ভাবনা তত্ত্বের প্রয়োগে নানা ধরনের অর্থনৈতিক সমস্যার সুরাহা করতে সক্ষম; যেমন--- শ্রমের মূল্য,দ্রব্যমূল্যের দাম,সময় সারণীর বিশ্লেষণ, বাজারে চাহিদার পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুধাবন ইত্যাদি সব বিষয় গুলিকে সহজবোধ্য এবং এই সমস্যা গুলোর হাল নিরসন সহজসাধ্য করে তুলেছে পরিসংখ্যান। কোন দেশের জনসংখ্যা এবং তাদের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, শিক্ষা দীক্ষা, স্বাস্থ্য,সম্পদ ইত্যাদির সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ তাত্ত্বিক ধারণা দেয় “পরিসংখ্যান” । এই প্রদত্ত তথ্য দেশের উন্নয়নের জন্য নীতি নির্ধারণে ব্যাপক সহায়তা করে।গটফ্রায়েড আচেনওয়াল নামে একজন ঐতিহাসিক, অর্থনীতিবিদ এবং দার্শনিক হলেন সেই সকল ব্যাক্তিদের মধ্যে একজন যিনি “স্ট্যাটিস্টিক্স” কে অর্থনীতির সাথে যুক্ত করেছিলেন।পৃথিবীর মধ্যে প্রথম পরিসংখ্যানবিদ হলেন উইলিয়াম প্লেফেয়ার,যিনি পরিসংখ্যানে লৈখিক উপস্থাপনার ধারণা দিয়েছিলেন। তিনি পংক্তি বর্ণনাচিত্র (লাইন চার্ট),দন্ড বর্ণনাচিত্র (বার চার্ট) এবং বারলেখ (হিস্টোগ্রাম) এর আবিষ্কার করেছিলেন। তবে পরিসংখ্যান জনক হিসেবে পৃথিবীতে পরিচিত স্যার রোনাল্ড ফিসার নামে একজন ব্রিটিশ পরিসংখ্যানবিদ। তিনি তাঁর সময়ের একজন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি পরিসংখ্যান বিদ্যায় তাঁর ‘পরীক্ষামূলক নকশা’ এবং ‘জনগনণা তত্ত্বে’র জন্য বিখ্যাত। তিনিই আধুনিক পরিসংখ্যানের জনক। সাথে সাথেই ভারতীয় পরিসংখ্যানের জনক হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ। ভারতীয় অর্থনীতিতে তাঁর উদ্ভাবনী পরিসংখ্যানের প্রায়োগিক গুরুত্ব এবং তাৎপর্যের কথা মাথায় রেখে তাঁর জন্মদিনে (২৯ শে জুন) পালিত হয় জাতীয় পরিসংখ্যান দিবস।২০০৭ খ্রীষ্টাব্দে ৫ই জুন ভারতীয় রাজপত্রে ঘোষিত হয় এই দিনটি পালনের কথা এবং ভারতের পরিসংখ্যান ও প্রকল্প বাস্তবায়ন মন্ত্রালয় দ্বারা সারা দেশ জুড়ে এই দিনটিকে পালন করা হচ্ছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে অধ্যাপক মহলানবীশের অনবদ্য ভূমিকার কথা স্মরণ করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এই দিনটি উদযাপিত হয়।
প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ ২৯শে জুন ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দে পশ্চিম বঙ্গের একটি শিক্ষিত এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। কলকাতায় প্রাথমিক শিক্ষা এবং ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দে তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে পদার্থ বিজ্ঞান এ সাম্মানিক স্নাতক হন। তারপর তিনি ইংল্যান্ড চলে যান, সেখানে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞান ও গণিতে ডিগ্রী অর্জন করেন। তারপর দেশে ফিরে এলে তাঁর একজন গৃহশিক্ষকের কাছে পরিসংখ্যান সম্পর্কে অবগত হন এবং তিনি এই বিষয়টির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দে প্রেসিডেন্সী কলেজ এ অধ্যাপনার সাথে সাথেই পরিসংখ্যান এর উপর প্রচুর পড়াশোনা করেন। সেই সময় তিনি পরিসংখ্যান পদ্ধতি গুলো কে নৃবিদ্যা,আবহবিদ্যা এবং জীববিদ্যার মধ্যে প্রয়োগ করেন। মানবদেহ পরিমাপ বিদ্যাতেও তিনি তাঁর পরিসংখ্যান ব্যবহার করেন। এরপর তিনি ১৯৩১ খ্রীষ্টাব্দের ১৭ই ডিসেম্বর কলকাতায় “ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট” প্রতিষ্ঠা করেন। একজন ফলিত পরিসংখ্যানবিদ হিসেবে তিনি তাঁর “মহলানবীশ দূরত্ব”(মহলানবীশ ডিস্ট্যান্স ) এবং “ফেল্ডম্যান-মহলানবীশ মডেল” নামে অর্থনৈতিক উন্নয়ন তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি ১৯৪৭-৫১ খ্রীষ্টাব্দ অবধি রাষ্ট্র সঙ্ঘের উপ নমুনা আয়োগের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।১৯৪৯ খ্রীষ্টাব্দে ভারত সরকার তাঁকে সম্মানীয় পরিসংখ্যান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করেছিল।১৯৫০ খ্রীষ্টাব্দে তিনি “ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে” প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ভারতবর্ষের দ্বিতীয় পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনার একজন সদস্য ছিলেন। ওই সময় তাঁর মস্তিষ্ক প্রসূত “নেহরু-মহলানবীশ মডেল” বেশ ফলপ্রসূ হয়েছিল। ভারতীয় অর্থনীতিতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি রয়েল সোসাইটির নবিশ নির্বাচিত হন, অর্জন করেছিলেন ‘ওয়েল্ডন মেমোরিয়াল প্রাইজ’ এবং ‘অফিসার অব দি অর্ডার অব দি ব্রিটিশ এম্পায়ারে’র খেতাব ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দে। ভারত সরকার তাঁকে ১৯৬৮ খ্রীষ্টাব্দে পদ্মবিভূষণ সম্মানে ভূষিত করে। ভারতীয় অর্থনীতিতে তাঁর অনস্বীকার্য অবদানের কথা মাথায় রেখেই তাঁর জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান করতেই এই দিন টি উদযাপন করা হয়।২০১৮ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট- এ এসে তাঁর ১২৫তম জন্মদিনে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি শ্রী ভেঙ্কাইয়া নাইডু মহাশয়, একটি স্মৃতি মুদ্রা প্রকাশ করেন।
তবে “পরিসংখ্যান” বা “স্ট্যাটিস্টিক্স” এর অনস্বীকার্য অবদানের কথা শুধুমাত্র ভারতবর্ষেই উদযাপিত হয় এমনটা নয়; সারা পৃথিবী জুড়ে পরিসংখ্যান দিবস পালিত হয়। “বিশ্ব পরিসংখ্যান দিবস” পালিত হয় প্রতি পাঁচ বছরে একবার,২০শে অক্টোবর। রাষ্ট্র সঙ্ঘের পরিসংখ্যান আয়োগের উদ্যোগে এই দিনটি উদযাপিত হয়ে আসছে ২০১০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে এবং এই একই বছর থেকেই ‘দি রয়েল স্ট্যাটিস্টিক্যাল সোসাইটি’ “গেটস্ট্যাটাস” নামে একটি পরিসংখ্যান স্বাক্ষরতা অভিযান চালিয়ে আসছে। ২০১০ খ্রীস্টাব্দের হিসেবে একত্রে পৃথিবীর প্রায় ১০৩টি দেশ জাতীয় পরিসংখ্যান দিবস পালন করে। এদের মধ্যে ৫১টি আফ্রিকার দেশ আবার আলাদা করে “আফ্রিকার পরিসংখ্যান দিবস” পালন করে প্রতি বছর ১৮ই নভেম্বর। প্রথাগত ভাবে ভারতবর্ষে এই দিনটি একটি বিশেষ উদ্দেশ্য পালনের লক্ষ্যে উদযাপিত হয়।২০২০ খ্রিস্টাব্দে এই দিনটি লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ, সুস্বাস্থ্য ও সুন্দর জীবনের লক্ষ্য নিয়ে পালিত হয়েছিল। আবার ২০২১ সালে এই দিনটি সুসংহত উন্নয়নের লক্ষ্যে উদযাপিত হয়: ক্ষুধা নিবারণ, স্থিতিশীল চাষাবাদ, পৌষ্টিক মানোন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তাই ছিল মূল লক্ষ্য। এবছরও সুসংহত উন্নয়নের জন্য তথ্যের যথাযথ ব্যবহারের বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এই দিনটি পালন করা হয়েছে। সত্যিই পরিসংখ্যান শুধু প্রয়োজনীয় তাই নয় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণও বটে। দেশে সুস্থায়ী সুসংগত উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে পরিসংখ্যান অত্যন্ত জরুরী। ভারতবর্ষের মতো যুবক দেশে তো বটেই, যেখানে তারুণ্যের অদম্য ইচ্ছেশক্তি ও মেধা একত্রে উন্নয়নের অভিমুখে অগ্রগামী। সুসংগত পরিসংখ্যানই পারে সুসংগত উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে;আর যুবক সম্প্রদায় যদি সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় তাহলে “আত্মনির্ভর ভারতবর্ষ” গড়ে উঠতে কোন অসুবিধায় রইবে না।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct