ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ একটি বহু আলোচিত ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহ, বেশির ভাগ আলোচনা বা বর্ণনা পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকদের কলমে এবং তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিতেই লেখা। ইউসুফ সালাদিন আয়ুবীকে ক্রুসেডের মহানায়ক হিসেবে তুলে ধরেছেন আরবীয় লেখক আমিন মালাউফ। তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বাংলা তরজমা করেছেন পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের প্রাক্তন সচিব আব্দুস শুকুর।
‘‘ইউসুফ তুমি বহুদূর এগিয়েছ,তুমি সব সীমা ছাড়িয়ে গেছ,তুমি নুর আল দিনের দাস ব্যতীত কিছু নও,কিন্তুসব ক্ষমতা নিজে দখল করতে চাইছ; এই ভুল করোনা আমরা যারা তোমাকে শুন্য থেকে এত উচুঁতে তুলেছি আবার মাটিতে নামিয়ে আনতেও পারি।‘’এ্যলেপ্পোর হোমরা চোমরা ব্যক্তিরা সালাদিনকে এসব কথা বলেছিলেন, কিন্তু কয়েক বছর পর এই কথাগুলি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছিল, কারণ ১১৭৪ খ্রি. থেকে যখন মিশরের নুতন সম্রাট পূর্ব আরবের নুতন শক্তি হিসেবে উঠে আসছিল, তিনিই সালাদিন ইউসুফ আযদিও প্রথম দিকে সবাই তাঁর ক্ষমতার এই আন্দাজ পাননি। নুর আলদীনের উৎসাহে তাঁর রাজত্বকালে এবং তাঁর মৃত্যুর পর তেমন ভাবে কেও ইউসুফের নাম উচ্চারন করতনা বলতো ভুঁইফোড়, উদ্ধত,অকৃতজ্ঞ এমন সব খারাপ খারাপ বিশেষণ। সালাদিন কিন্তু এ সবের উর্ধে ছিলেন। তিনি ঔদ্ধত্য দেখাতেন না বরং বর্জন করতেন। কিন্তু কপালের ফেরে তাঁর বিপরীত পক্ষের লোকেরা এমনই মনে করতো এবং বিরক্ত হতো। ৩৬ বছরের এই কুর্দ কিন্তু উচাকাঙ্খী ছিলেন না, যারা তাকে জানতেন তারা বুঝতেন যে সামান্য আমির বা সেনানায়ক হিসেবে থাকাই তিনি নিজেকে যথেষ্ট মনে করতেন যদিও নানা ভবে ইতিহাসের নানাা অলিগলি ঠিক তাকে ইতিহাসের সামনের সারিতে এনে ফেলেছিল। বেশ অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি তার চাচার সাথে মিশরে আসেন ও সে দেশ জয়ে সামান্য ভূমিকা পালন করেন,নজরকাড়া আত্মত্যাগ তাকে সবার নজরে এনে দেয়.ও তাঁকে সর্বোচচ উচচ্চতায় পৌঁছে দেয়। সেই সময়ের ক্ষমতাধর ফাতিমীয়দের পতন তিনি নিজে কখনও ঘোষনা করেননি,যখন ইহা করতে বাধ্য হলেন তখন তিনি নিজেই ক্ষমতা ধর মুসলিম শাসকদের নেতা হয়ে গেলেন এবং যখন নুর আল দিন তাকে ক্ষমতায় বসাতে চাইলেন কোনও প্রতিবাদ দরকার হল না, নুর আল দিন ১১ বছরের নাবালক আল সালিকে ওয়ারিশ রেখে মারা গেলেন, তাই সালাদিন অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে গেলেন।
দুই মাস পরেই, ১১৭৪ সালের ১১ই জুলাই আলমাইরা ও মারা গেলেন। আমাশয়ের শিকার। যখন তিনি আর একবার মিশর আক্রমণের উদ্যোগ করছিলেন, এই সময় শক্তিশালী সিসিলিয়ান নৌবাহিনীর সাহায্য নিয়ে। এবং জেরুযালেম রাজ্য তার ছেলে চতুর্থ বল্ডউইনকে দান করে দেন। ত্রিশ বছরের তরুণ খুব খারাপ রকমের কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ছিলেন। সমগ্র প্রাচ্যে সালাদিনের বিরুদ্ধে দাড়াবার মত একমাত্র শাসক ছিল ম্যানুয়েল, রুমের সম্রাট যিনি সিরিয়া অধিকার করার ও ফরাসীদের সাহায্যে মিশর আক্রমনের ভাবনা করতো, কিন্তু ১১৭৬ সালে অপ্রত্যাশিত সালাদিনের কিছু সৌভাগ্য এমন ঝরে পড়ল,শক্তিশালী বাইজানটাইন সেনাবাহিনী যাহা নুর আল দীনকে ১৫ বছর আটকে রেখেছিল, সেই বাহিনী কিলিজ আরসালানের পৌত্র কিলিজ আরসালান-এর হাতে মিরিকোফেলমের যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে গেল, খুব তাড়াতাড়ি ম্যানুয়েলের মৃত্যু হল। প্রাচ্যে খ্রিস্টান রাজত্ব ঝামেলা ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে গেল।এখন এসবের মধ্যে সালাদিনের ভাগ্যে দৈবের হাত সন্ধান করেন তবে দোষ দেওয়া যায় কি, ইউসুফ কখনও তার সাফল্যের জন্য ভাগ্যের দোহাই দেননি, তিনি সর্বদা তার সাফল্যের জন্য প্রথমে আল্লাহ পরে চাচা, শিরুখ ও মনিব নুর আল দিনের প্রশংসা করেছেন। সালাদিনের বিনয় তাঁর মহত্বের পরিচায়ক ছিল।এই ঘটনা,এই সময় ঘটনা ক্লান্ত সালাদিন তাঁর শিবিরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন একজন চাকর একটি কাগজ সইয়ের জন্য দিল,’আমি খুবই ক্লান্ত’,সুলতান বললেন। ‘এক ঘন্টা পরে এস’ চাকরটি জিদ করতে লাগল, কাগজ মুখের কাছে ধরে সই করে দিতে বলল,সুলতান বললেন,’ এখানে কালির দোয়াত নাই’ সুলতান শিবিরের মুখেই ছিলেন, চাকর বলল, হুজুর পিছনের দিকে আছে, তার মানে সুলতান কেই গিয়ে দোয়াত এনে সই করা বোঝালো , ক্লান্ত দেহে সালাদিন তাই করলেন, সুলতানের অসাধারন বিনয়ের পরিচয়। বাহা আলদিন সুলতানের ব্যক্তিগত সহায়ক ও জীবনীকার কিছু বর্ননায় তিনি বলেছেন, সালাদিন অন্য শাসকদের থেকে কত আলাদা ছিলেন, বিনয়ীর সাথে তিনি চরমতম বিনয়ী ছিলেন। ক্ষমতার শীর্ষে থাকাকালীন একই রকম বিনয়ী ছিলেন। জীবনীকাররা তাঁর সাহস ন্যায় পরায়নতা, জিহাদের আকাঙ্খা ও মানবিক গুনের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বাহা আল দীন আবার বলেছেন, ফররাসীদের বিরুদ্ধে জেহাদের ঘোষনা দিচ্ছিলেন একটি চিঠি হাতে পাঠকালে এমন আবেগ প্রবন হলেন এবং কাঁদতে শুরু করলেন,চোখ দিয়ে বিগলিত অশ্রু দেখা গেল,আমরা যারা ছিলাম আমাদেরও চোখে পানি এসে গেল, যদিও আমরা মুল বিষয়টি জানতেই পারলামনা। অবশেষে তাঁ গলা রুদ্ধ হয়ে গেল কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন. ‘আমার ভাইপো তাপি আল দিন আর নেই’ দরদর ধারায় অশ্রু তাঁর বুক দিয়ে নেমে এলো,আমাদেরও। যখন সম্বিত ফিরে পেলাম, আমি বললাম এই বিশাল কাজের প্রেক্ষিতে আল্লাহ আমাদের এই আত্ম বিস্মরণ মাপ করবেন, তিনিও বললেন ঠিকই বলেছো। আল্লাহ আমাকেও মাপ করুন। তিনি বারবার বলতে লাগলেন।,অবশেষে বললেন কেউ যেন এ ঘটনা না জানতে পারে,অবশেষে গোলাপ পানি আনিয়ে চোখ ধৌত করলেন।
নিকট জনদের মৃত্যুর ঘটনা ছাড়াও অন্য সময়েও তাঁর চোখে পানির বন্যা দেখা যেত,নীচের ঘটনা বাহা আল দিন বলেছেন, একবার ফরাসীদের বিরুদ্ধে অভিযানে আমি সঙ্গে ছিলাম, রাস্তায় সৈন্যরা ক্রন্দন রত এক বৃদ্ধাকে তাঁর কাছে আনল,সে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে জানালো ফরাসী শিবির থেকে আসছে, সুলতানের কথার পিঠে জানালো গত রাতে মুসলিম সৈন্যরা/চোরেরা আমার ছোট মেয়েকে লুটে নিয়ে এসেছে, শুনেছি মুসলমানদের বাদশাহ দয়ালু তাই তাঁর কাছে এসেছি। আমার ভরষা আপনার উপর, আমার মেয়েকে ফেরাবার ব্যবস্থা করুন,হুজুর। সালাদিন বিগলিত হলেন,চোখে পানি এসে গেলো এজনকে দাস বাজারে পাঠালেন মেয়েটির খোঁজে এক ঘন্টার মধ্যে একজন ঘোড়সওয়ার মেয়েটিকে নিয়ে হাজির হল, বুড়ি মেয়েকে পেয়ে সুলতানের পায়ে পড়ে গেল, আকাশের দিকে হাত তুলে দোওয়া করতে লাগলো, সুলতানও আবেগে কাঁদতে লাগলেন, সঙ্গের আমরাও। খুসী মনে মা মেয়ে ফরাসী শিবিরে ফিরে গেল।যারা সালাদিনকে জানতেন,তারা খুব কমই তাঁর চেহারার বর্ণনা দিয়েছে, তিনি ছোটখাট রোগা মানুষ মুখে অল্প পরিষ্কার দাড়ি, চিন্তাশীল ও বেদনা মাখা মুখমন্ডল, কথা বলার সময় হঠাৎ হঠাৎ মুখ হাসিতে ভরে যেতো, মানুষ সহজেই কথা বলতে পারতো।দর্শকদের কাছে তিনি সহজগম্য থাকতেন,সবাইকে কিছু খাওয়ার জন্য জোর করতেন। সম্মানের সহিত ব্যবহার করতেন, অবিশ্বাসী হলেও, সন্তুষ্ট করতেন ঠিকভবে। কেউ হতাশ হয়ে ফিরে যাক তা পছন্দ করতেনা না বহু মানুষ এই গুনের সুযোগ নিত। একবার ফরাসীদের সাথে যুদ্ধ বিরতির সময়, এ্যন্টিয়কের দখলদার ব্রিন হঠাৎ এসে চার বছর আগে দখল করা গ্রাম ফেরৎ চান, সুলতান সাথে সাথে রাজী হয়ে যান, অনেক সময় এই উদারতা দায়িত্বজ্ঞনহীন হয়ে পড়তো, ও বিপদ ডেকে আনত। তার কোষাধ্যক্ষ বাহা আলদীন বলেছেন, সুলতাানের হাতখোলা স্বভাবের জন্য সবসময় কিছু পয়সা জরুরী খরচ হিসেবে লুকিয়ে রাখতে হতো তারা জানতেন সুলতান যদি জমানো টাকার কথা জানতে পারেন তবে তখনই তাহা সৎকাজে খরচ করে ফেলবেন। এত সব সাবধানতা সত্ত্বেও সুলতানের মৃত্যুর পর মাত্র এক টুকরো সোনা ও ৩৭টি রুপোর টাকা কোষাগারে অবশিষ্ট ছিল। সুলতানের হিতৈষীরা যখন তার এই উদার হাতের জন্য ধমক দিতেন, তখন উদার হাসি দিয়ে সব কিছু ঢেকে দিতেন। বলতেন টাকা তো বালির মতন; প্রকৃতপক্ষে পক্ষে পয়সাও ভোগ বিলাসকে তিনি অন্তর থেকে ঘৃণা করতেন যখন ফাতিমি সাম্রাজ্যের রাজপ্রসাদ গূলি তার হাতে এল, এগুলি সব আমিরদের দিয়ে নিজে উজিরদের জন্য বরাদ্দ ছোট ঘরে চলে গেলেন। নুর আল দীন ও সালাদিন দুজনেরই এই মহৎ গুণগুলি ছিল, সালাদীনের যারা বিরোধী তারা বদনাম করতো যে তিনি তার গুরু নুর আল দীনের অক্ষম অনুকরন কারীই মাত্র অবশ্য তার অধস্তন সৈন্যদের সাথে ব্যবহারে অনেক আন্তরিক ছিলেন, যদিও তিনি ইসলামের একান্ত অনুরাগী ছিলেন তবু জাঙ্গি এবং অন্য সুলতানদের মতো গোঁড়া ছিলেন না। সাধারণ ভাবে বলা যায় তিনিও নুর আল দিনের মতই আত্মনিবেদিত ছিলেন। কিন্তু অন্যদের প্রতি অনেক বেশী সহনশীল ছিলেন, কিন্তু ইসলাম অবমাননাকারীদের উপর অনেক বেশী নির্দয় ছিলেন। তারা ধর্মদ্রোহী বা ফরাসী যেই হোক।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct