অসম উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার। চিন-বাংলাদেশের মাঝখানে অসমের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব প্রবল। ফলে নয়াদিল্লি থেকে অসমের দিকে মনোযোগ বেশ তীব্র। বিজেপির কাছেও এই রাজ্যের গুরুত্ব প্রবল। অসমিয়ারাও অসমে কোনোভাবে ‘নেতৃত্ব’ হারাতে অনিচ্ছুক। কিন্তু ৩৩ ভাগ সংখ্যালঘু ভোটার একক কোনো পছন্দে শামিল হলে অসমিয়াদের নির্বাচনী সমীকরণ মেলানো অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়। স্থানীয় সংখ্যালঘুরা এতে সূদূরপ্রসারী এক বিপদের আভাস পাচ্ছেন। বিশ্লেষণ করেছেন আলতাফ পারভেজ। আজ শেষ কিস্তি।
অসমে মুসলিমদের মাঝে যে ৫টি গোষ্ঠীকে খিলঞ্জিয়া বলা হচ্ছে তারা পুরো মুসলিমদের প্রায় ৩০ ভাগ। এদের নতুন পরিচয়ের একাধিক পরোক্ষ মানে দাঁড়াবে বলে মনে হচ্ছে। প্রথমত, এতে করে ‘অপর সংখ্যালঘুরা’ ভূমিপুত্র নয় বলেই চিহ্নিত হবে। দ্বিতীয়ত ‘খিলঞ্জিয়া’রা অসমিয়া হিসেবে পরিচিত হবে, অন্যরা তা নয়। তৃতীয়ত, ‘ভূমিপুত্র মুসলিমরা’ যেসব সুযোগ-সুবিধার অধিকারী হবে, অন্য মুসলিমরা তা না–ও হতে পারেন। চতুর্থত, অভূমিপুত্র সংখ্যালঘুদের মধ্যে যেহেতু বাংলাভাষীরাই একচেটিয়া, সুতরাং চাইলে তাঁদের পুরোনো ধাঁচে ‘সীমান্ত পেরিয়ে আসা’ মানুষ বলেও উল্লেখ করা যাবে, এমনকি নাগরিকপঞ্জিতে তাঁদের নাম থাকলেও। পঞ্চমত, সামাজিক বৈরিতা এড়াতে বাংলাভাষী সংখ্যালঘুদের মাঝে ‘অসমিয়া মুসলিম’ হিসেবে শনাক্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়বে, তাতে ভাষা হিসেবে বাংলার বিপরীতে অসমিয়ার সংখ্যাগত প্রাধান্যও সবল হবে। ষষ্ঠত, অবাংলাভাষী খিলঞ্জিয়া মুসলিমদের মাঝেও পৃথক পৃথক গোষ্ঠী চেতনার মাধ্যমে পারস্পরিক দূরত্ব বাড়বে।
এসব পার্শ্বফল জড়ো করলে পরিস্থিতির বৃহত্তর মানে দাঁড়ায় মুসলিমদের মাঝে শুরুতে খিলঞ্জিয়া এবং অখিলঞ্জিয়া দুটো ভোটব্যাংক হবে এবং তার মাঝে আবার ধীরে ধীরে অনেক উপধারারও তৈরি হবে। এ রকম সবার স্বার্থও আলাদা হয়ে যাবে। ফলে তাদের এত দিনকার ‘৩৩ ভাগ ভোটব্যাংকে’র গণিত আগের মতো কাজ করবে না। সংখ্যালঘু সমাজের এই ফাটল নিশ্চিতভাবে সমাজ-অর্থনীতিতেও ছড়াবে, একক রাজনৈতিক বর্গ আকারে আর আগের মতো এক কাতারে দাঁড়ানো তাঁদের জন্য কঠিন হবে। এমনকি সামাজিকভাবেও তাঁরা ক্রমে ছিন্নভিন্ন হতে থাকবেন। বিশেষ করে চরাঞ্চলের দরিদ্র বাংলাভাষী সংখ্যালঘুরা এতে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে আরেক দফা দুর্বল হতে পারেন। যাঁরা সাধারণভাবে ‘মিয়া’-সংখ্যালঘু হিসেবে পরিচিত। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা গত বিধানসভা ভোটের আগে মিয়া-সংখ্যালঘুদের প্রতি তাঁর বিশেষ বিরাগের কথা জানিয়ে বলেছিলেন, সবার ভোট চাইলেও তিনি মিয়াদের ভোট চান না। নতুন খিলঞ্জিয়া কার্ডের আগেও মুসলিম সমাজে সীমিত পরিসরে নানা বিভেদ ছিল। এগুলো মূলত নানা ঐতিহাসিক অবস্থারই জের। একটা ফারাক ছিল বরাক ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যাকার সংখ্যালঘুদের স্বার্থগত হিসাব-নিকাশে। আরেকটা আছে বাংলাভাষী সংখ্যালঘু ও অসমিয়া সংখ্যালঘুদের মাঝে। বাংলাভাষী সংখ্যালঘুরা এই রাজ্যে যতটা চরাঞ্চলের কৃষিজীবী, অসমিয়া সংখ্যালঘুরা ততটা নন। এ রকম ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যে রাজ্য সরকারের নতুন ঘোষণায় ভালোভাবেই প্রশাসনিক সিলমোহর পড়ল। নিশ্চিতভাবে এটা কেবল নৃতাত্ত্বিক কোনো উদ্যোগ নয়, বরং একই সঙ্গে রাজনৈতিক প্রকল্প। রাজ্য প্রশাসন ইঙ্গিত দিচ্ছে, নতুন ঘোষণার আলোকে সংখ্যালঘুদের মাঝে একটা জরিপও চালানো হবে, কারা আদি বাসিন্দা, আর কারা নয়, সেটা বুঝতে। এসবই সংখ্যালঘুদের মাঝে বিভেদের অস্থিরতা বাড়াতে পারে। নাগরিকপঞ্জি অধ্যায়ের পর মুসলিমদের এভাবে নতুন এক সামাজিক টানাপোড়েনের দিকে নেওয়া হচ্ছে কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে। সর্বশেষ ঘোষণার একটা কৌতূহল উদ্দীপক দিক হলো এতে বরাক উপত্যকার সংখ্যালঘুদের মাঝে তেমন ‘আদি বাসিন্দা’ মেলেনি!
ভারতীয় পরিসরে অসম এখন ক্ষুদ্র এক রাজ্য। কিন্তু সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে হিমন্তবিশ্ব শর্মার সর্বভারতীয় অবস্থান উল্টো। তিনি আরএসএস পরিবারে সামনের সারির একজন। সফলতায় এবং বুদ্ধিমত্তায় নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ এবং যোগী আদিত্যনাথের পরই হিন্দুত্ববাদী শিবিরে তাঁর অবস্থান। নিজের এই অবস্থানকে ধরে রাখতে এবং এগিয়ে নিতে হলে অসমে তাঁকে নিরঙ্কুশ অবস্থা তৈরি করতেই হবে। অসমের রাজনীতিতে অ-বিজেপি অসমিয়া ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সঙ্গে বাংলাভাষী সংখ্যালঘু ভোটের যৌথতা তাঁর জন্য এক দূরবর্তী সমস্যা। সেই বিবেচনাতেই বদরুদ্দীন আজমলের সংখ্যালঘু প্রধান ইউডিএফ দলটিকে দুর্বল করা স্থানীয় বিজেপির জন্য দীর্ঘদিন থেকে প্রধান কর্তব্য আকারে আছে। ৫টি অ-বাংলাভাষী সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে ভূমিপুত্র হিসেবে স্বীকৃতি সেই লক্ষ্যের সঙ্গে বেশ খাপ খাওয়ানো একটা ব্যাপার মনে করছেন অনেকে। নিঃসন্দেহে এটা অসম বিজেপিকে ভবিষ্যতে কিছুটা বিপদমুক্ত রাখতে পারে। অতীতে অসমের শাসকেরা সচরাচর রাজ্যের রাজনীতিকে জাতিগত লাইনে বিভক্ত করার চেষ্টায় ছিলেন, বিজেপি তাকে ধর্মীয় ধারায় বদলে নিচ্ছে ক্রমে।
(সমাপ্ত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct