অসম উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার। চিন-বাংলাদেশের মাঝখানে অসমের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব প্রবল। ফলে নয়াদিল্লি থেকে অসমের দিকে মনোযোগ বেশ তীব্র। বিজেপির কাছেও এই রাজ্যের গুরুত্ব প্রবল। অসমিয়ারাও অসমে কোনোভাবে ‘নেতৃত্ব’ হারাতে অনিচ্ছুক। কিন্তু ৩৩ ভাগ সংখ্যালঘু ভোটার একক কোনো পছন্দে শামিল হলে অসমিয়াদের নির্বাচনী সমীকরণ মেলানো অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়। স্থানীয় সংখ্যালঘুরা এতে সূদূরপ্রসারী এক বিপদের আভাস পাচ্ছেন। বিশ্লেষণ করেছেন আলতাফ পারভেজ। আজ প্রথম কিস্তি।
অসমের সংখ্যালঘু মানেই চিরস্থায়ী চ্যালেঞ্জে থাকা এক জনগোষ্ঠী। ‘বিদেশি খেদাও’ আন্দোলনের দুঃসহ স্মৃতির পর ‘নাগরিকপঞ্জি’–এর সংকট পেরোতেই এখন তাদের নতুন চ্যালেঞ্জে ফেলা হল। সম্প্রতি রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অসমের সংখ্যালঘু সম্প্রদারের ৫টি উপধারাকে ‘ভূমিপুত্র’–এর স্বীকৃতি দেওয়া হবে। আপাতদৃষ্টিতে এই সিদ্ধান্তকে বেশ নিরীহ এবং অভিনন্দনযোগ্য মনে হলেও স্থানীয় সংখ্যালঘুরা এতে সূদূরপ্রসারী এক বিপদের আভাস পাচ্ছেন। সংখ্যালঘু ভোটব্যাংক বিভক্ত করার চেষ্টা চলছেই ভারতে মুসলিম সংখ্যালঘু জনসংখ্যার ৬ দশমিক ২ ভাগ থাকে অসমে। সংখ্যায় এক কোটির সামান্য বেশি। সর্বভারতীয় লোকসংখ্যার বিচারে এই জনসংখ্যা অতি নগণ্য দশমিক ৮৮ ভাগ মাত্র (.৮৮%)। কিন্তু এই সংখ্যালঘুদের নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা এবং নজরদারির শেষ নেই। প্রতিনিয়ত তাঁদের খবর হিসেবে তুলে আনা হয়। বিশেষ করে এমন ‘উদ্বেগ’ প্রায়ই ছড়াচ্ছে—রাজ্যটি সংখ্যালঘু-প্রধান হয়ে যাচ্ছে! অথচ এই রাজ্যের ৩৩টি জেলার চার ভাগের তিন ভাগেই সংখ্যালঘু সংখ্যালঘু। পুরো রাজ্যে তাদের হিস্যা এক–তৃতীয়াংশ মাত্র (৩৪ দশমিক ২২ শতাংশ)। অর্থনৈতিক বিবেচনাতেও তাদের বড় অংশ গণহারে নিম্নবর্গ বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলাভাষীরা। আর্থসামাজিক বঞ্চনা এবং ধর্মীয় বৈরিতার শিকার যেকোনো জনগোষ্ঠী যেকোনো দেশে সচরাচর এক কাতারে থাকতে চায়। অসমে সংখ্যালঘুদের মাঝেও এ রকম প্রবণতা আছে। কিন্তু ভোটের অঙ্কে সেটা অসমিয়া প্রভাবশালীদের জন্য বিপত্তিমূলক। ফলে সংখ্যালঘু ভোটব্যাংককে বিভক্ত করার একটা পুরোনো প্রচেষ্টা জারি ছিল বহুকাল থেকে। সম্প্রতি তা বেশ পরিণত আদল পেল রাজ্য সরকারের এক ঘোষণায়।
অসম উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার। অসমের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব প্রবল। ফলে নয়াদিল্লি থেকে অসমের দিকে মনোযোগ বেশ তীব্র। বিজেপির কাছেও এই রাজ্যের গুরুত্ব প্রবল। অসমিয়ারাও অসমে কোনোভাবে ‘নেতৃত্ব’ হারাতে অনিচ্ছুক। কিন্তু ৩৩ ভাগ সংখ্যালঘু ভোটার একক কোনো পছন্দে শামিল হলে অসমিয়াদের নির্বাচনী সমীকরণ মেলানো অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়। তবে সেটা এবার সহজ হতে পারে হিমন্তবিশ্ব শর্মা সরকারের পরিকল্পনায়। বলা হয়েছে, গরিয়া, মরিয়া, দেশি, জোলা এবং সৈয়দ নামের পাঁচ সংখ্যালঘু গোষ্ঠীধারাকে অসমে ‘খিলঞ্জিয়া’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। খিলঞ্জিয়া বলতে বোঝানো হচ্ছে যারা অসমে পুরোনো জনগোষ্ঠী তথা আদি বাসিন্দা। রীতিমতো সরকারি সাতটি কমিটি ‘দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে’ এ রকম একটা ঐতিহাসিক সুপারিশ জানাল এবং রাজ্য সরকার মন্ত্রিসভার বৈঠকের মাধ্যমে তা তাৎক্ষণিকভাবে মেনে নিয়েছে। কথিত এই ভূমিপুত্রদের ‘পরিচয়পত্র’ দেওয়া হতে পারে বলেও স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বিবরণ দিচ্ছে। তবে কিসের ভিত্তিতে কথিত এই জনগোষ্ঠীগুলো ‘আদি বাসিন্দার’ তকমা পেল তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা সরকারি-বেসরকারি কোনো তরফ থেকে জানা যায়নি। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে বিতর্কও উঠেছে। যেমন আদি বাসিন্দা অসমিয়া মুসলিম হিসেবে সবার আগে যাদের নাম রয়েছে, সেই ‘গরিয়া’ মুসলিমদের এত দিন অসমিয়া সমাজবিজ্ঞানীরা বাংলার পুরনো রাজধানী গৌড় থেকে যাওয়া বাসিন্দা বলে আসছিলেন। কেউ কেউ তাদের সপ্তদশ শতাব্দীতে অসম অভিযানে যাওয়া মোগল সৈনিকদের বংশধরও বলতেন। কিন্তু এখন তাদেরই অসমের খিলঞ্জিয়া স্বীকৃতি দেওয়া হলো। অসমের সংখ্যালঘু সমাজে খিলঞ্জিয়া খুঁজে পাওয়ার এই উদ্যোগটি ১৯৮৫ সালের ‘অসম চুক্তি’র আলোকেই নেওয়া হয় বলে জানানো হচ্ছে। যে চুক্তি হয়েছিল মূলত অসমিয়াদের দাবি অনুযায়ী অসম থেকে ‘বিদেশিদের’ তাড়াতে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct