যে অপরাধের নেপথ্যে মায়ের অন্ধ পুত্রস্নেহ
সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়
সেবা মহৎ কাজ কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে সেটা মূর্খতাও বটে। মানুষ যাতে সাবধান থাকতে পারে তার জন্য এইরকম একটি দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরলাম। কলকাতা শহরতলীর বাড়িতে বিধবা কাবেরী বসু একাই থাকেন। ৪০ বছর বয়সী একমাত্র ছেলে ‘সোহম ‘ চাকরীসুত্রে সপরিবারে দূরে থাকে, ২-৩ মাস পর পর সে বাড়ি আসে। কাবেরী একা, তাই তাঁর নানা বিপদে পাড়ার ৩০ বছর বয়সী ছেলে ‘দেবেশ’ ছুটে আসে, অসুখ করলে ডাক্তারখানায় নিয়ে যায়, ওষুধ আনে। কোনও জিনিষ কিনতে হলে, বাড়িতে কোনও মিস্ত্রী ডাকতে হলে ‘দেবেশ’ - ই কাবেরীর ভরসা। ছেলে সোহম ২-৩ মাস পর বাড়ি এলে স্ত্রী এবং একমাত্র ছেলেকে নিয়ে পাশের ঘরে তাদের নিজেদের মতো করে থাকে। মাকে তো সে তেমন দেখেইনা বরং অতিরিক্ত কর্কশ ব্যবহার করে। বিপদে কাবেরী তখনও দেবেশকেই ডাকেন। দেবেশের মা নেই। কাজেই কাবেরীকে মায়ের মতো সেবা করে মনে মনে সে মায়ের স্নেহ অনুভব করে। কাবেরী ‘বাবা দেবেশ’ বলে ডাকলে সে আবেগে গলে যায়। বাড়ি এসে সোহম একটা কাজ করে, তা’ হল এলাকার ক্লাব ‘নতুন যুগ সংঘ’ - এ সে রোজ যায়। ক্লাবের ফুটবল টুর্নামেন্ট, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচী, প্রাকৃতিক দুর্যোগে অর্থ-সংগ্রহ, রক্তদান শিবির এ’সবেই সে মেতে থাকে। এলাকায় তাই তার সামাজিক প্রতিচ্ছবি খুব উজ্জ্বল। এইভাবেই এতকাল চলে আসছিল।কিন্তু সেবার বাড়ি আসার পর সোহমের মাথায় একটু অন্য চিন্তা খেলে গেল। দেবেশের ওপর মায়ের এই স্নেহ সোহমের ভালো লাগছিলনা। মায়ের সঙ্গে নিজের এই মাসসিক দূরত্ব সে কমিয়ে আনার চিন্তা এবং চেষ্টা করতে লাগল। এজন্য মাকে সে ভালো কাপড় কিনে দিল। রোজই মা’র জন্য ভালো খাবার কিনে আনা, শরীরের খবর নেওয়া, তাঁর গা, হাত-পা টিপে দেওয়া ইত্যাদি সোহম করতে লাগল। প্রকৃতির নিয়মেই ১০ মাস ১০ দিন নিজের গর্ভে ধারণ করা সন্তানের এই আচরণে গলে গিয়ে , অতীতের সব কিছু ভুলে, মা তাকে বুকে টেনে নিলেন।
দেবেশ তার অভ্যাস মতো সেদিনও কাবেরীর কাছে এসেছিল। শুধুমাত্র ঝগড়া বাঁধাবার উদ্দেশ্যে সোহম তাকে পাশের ঘরে ডেকে নিল। প্রচণ্ড গরম স্বরে মিথ্যে করে বলে উঠল, “ তুই কি ভেবেছিস বল্তো, এটা কি তোর নিজের বাড়ি, না বারোয়ারী জায়গা? মায়ের ঘরের টেবিলে আমার একটা ডাইরী ছিল,সেটাকে তুই সরিয়ে রেখেছিস? সেফটি রেজারটা আমি আয়নার সামনে রেখেছিলাম, না বলা,কওয়া সেটাকে বাথরুমে নিয়ে গেছিস? ইডিয়েট, শুয়োর কোথাকার, একটা চড়ে তোমার বদন বিগড়ে দেব, জানোয়ার”। অভিযোগগুলো ছিল সম্পূর্ণই মিথ্যা। কিন্তু প্রতিবাদ করে দেবেশ কিছু বলতে গেলে আরও চড়া স্বরে সোহম চেঁচিয়ে উঠল, “ এই গালাগাল দিলি কেন রে? এটা ভদ্রলোকের বাড়ি”। সুঠাম চেহারার সোহম আঙুল তুলে বলে উঠল, “গালাগাল নিজের বাড়িতে গিয়ে দিবি”। গালাগাল আদৌ দেবেশ দেয়নি বরঞ্চ সোহমই দিয়েছিল। কিন্তু রোগা, কমজোরী আর লোকবলহীন দেবেশ যেই প্রতিবাদ করে বলতে গেল, “গালাগাল আমি কোথায় দিলাম”, অমনি আরও উগ্রভাবে একটা চড় দেখিয়ে সোহম বলে উঠল, “ একদম ফালতু কথা বলবি না ,এইমাত্র মুখে বলেছি, এবার সত্যিই একটা চড়ে তোমার গাল ঘুরিয়ে দেব,সমস্ত ন্যাকামো ছুটে যাবে “। চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে কাবেরী ছুটে এলেন। ছেলের সাথে সুর মিলিয়ে তিনিও দেবেশকে ধমকে উঠলেন, “গালাগাল দিচ্ছ কেন? বেরিয়ে যাও ঘর থেকে, এটা ভদ্রলোকের বাড়ি, গালাগালের জায়গা এটা নয়, অসভ্য জানোয়ার কোথাকার। ঐসব গালাগাল যেখানে চলে, সেখানে গিয়ে দেবে, ,ছোটলোক কোথাকার”। বিধ্বস্ত গলায় দেবেশ বলতে গেল, “গালাগাল আমি তো দিইনি, বরং তোমার ছেলেই তো আমায় গালাগাল...”। কথা শেষ করতে দিলনা, “ এবার লাথি মেরে তোমার মাজা ভেঙ্গে দেব”, সোহম ঝাঁঝিয়ে উঠল। কাবেরীও চেঁচিয়ে উঠলেন, “একদম বাজে কথা বলবিনা,ইডিয়েট, বেরোও ঘর থেকে, নির্লজ্জ বেহায়া”।
সোহমের মায়ের এই আচরণে দেবেশ স্তব্ধ হয়ে গেল। তবু বাস্তবের তাগিদে, অতি কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে অপমানে বিধ্বস্ত ক্ষত-বিক্ষত হয়ে দেবেশ ওই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল।সোহমের বাড়ি থেকে বেরিয়ে, বেইমানী আর অপমানের জ্বালায় দগ্ধ দেবেশ সোজা হেঁটে গেল গঙ্গার ধারে। একটা ফাঁকা জায়গায় অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। ভাবতে লাগল, “ এতদিন আমিই তো এই অসহায় মহিলাকে দেখেছি, তাঁর পাশে থেকেছি, তাঁর সব কাজ করেছি, তখন তাঁর নিজের ছেলেটা কোথায় ছিল”? নিজের থেকেই তার মনে হল, দোষ তো তার নিজেরই, তার নিজের বাস্তব বোধের। আমাদের দেশের মায়েরা পুত্র-স্নেহে এমনই অন্ধ থাকেন যে, মা-বিমুখ কোনও ছেলে যদি একবার মায়ের কাছে ফিরে আসে এবং একটু ভালো ব্যবহার করে, তখন সব তিক্ত অতীত ভুলে, পুত্র-স্নেহে অন্ধ হয়ে,মা তাকে বুকে টেনে নেন। ছেলেকে সমর্থন করতে গিয়ে বিগত খারাপ দিনের অতি দুঃখের সাথীর বিরুদ্ধাচরণ করতেও তাঁর বাধেনা। আর নিয়মিত ক্লাবে যাওয়া এবং বিভিন্ন সামাজিক কাণ্ডে নিজেকে জড়ানো? এদেশে অতিশয় দূরভিসন্ধিপূর্ণ মানসিকতার লোকও ভালো মানুষের পাশাপাশি ক্লাবে যায় ও নানা সামাজিক কাজে নিজেকে জড়িয়ে রাখে, সারা বিশ্বের সাথে বাঙালী সমাজের এটি একটি মৌলিক পার্থক্য। সমগ্র ঘটনাটি একটি রুঢ় বাস্তব। দুঃখ ও আক্ষেপ না করে, নিজের জীবনের এই তিক্ত ও আঘাতদায়ী অভিজ্ঞতাকে অন্যের সামনে তুলে ধরাকেই দেবেশ এখন থেকে তার এক সামাজিক কর্ত্তব্য বলে মনে করল, যাতে এটা জানতে পেরে অন্যেরা সাবধান হতে পারে এবং আঘাত না পায়। এই কাহিনীটি তারই এক পদক্ষেপ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct