সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বিশ্ব যতগুলো সংকটের মুখে পড়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে দেখা দেওয়া মহামারি সবে কাটতে শুরু করেছিল। ঠিক এমন একটি সময়ে ইউরোপে আরেকটি বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। সেটি হল ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ। আমাদের বিশ্ব যে কতটা ভঙ্গুর, আন্তসংযুক্ত এবং পরস্পর নির্ভরশীল, এই যুদ্ধ তা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে; চিনারা যেমনটা বলে থাকেন, ‘আসমানের নিচে সব এক’। মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন তুর্কি বিন ফয়সাল আল-সৌদ।
সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বিশ্ব যতগুলো সংকটের মুখে পড়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে দেখা দেওয়া মহামারি সবে কাটতে শুরু করেছিল। ঠিক এমন একটি সময়ে ইউরোপে আরেকটি বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। সেটি হল ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ। আমাদের বিশ্ব যে কতটা ভঙ্গুর, আন্তসংযুক্ত এবং পরস্পর নির্ভরশীল, এই যুদ্ধ তা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে; চিনারা যেমনটা বলে থাকেন, ‘আসমানের নিচে সব এক’। বৃহৎ-শক্তিগুলোর সংঘাত এবং বিশ্বায়ন–বিযুক্তির প্রবণতা তীব্রতর হওয়া বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে তুলছে। মনে হচ্ছে, নতুন সংকট প্রতিটি কোণে লুকিয়ে আছে, কিন্তু উপযুক্ত সমাধান কোথাও দেখা যাচ্ছে না। দূরপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা থেকে শুরু করে সাব-সাহারান আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপ বা লাতিন আমেরিকা—কোথাও না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এ পর্যন্ত মানবজাতি যেসব প্রগতিবাহী সাফল্য অর্জন করেছে, তা জনতুষ্টিবাদ, জাতীয়তাবাদ, ইসলামবিদ্বেষ এবং অন্যান্য অ্যাকটিভিস্টিক প্রবণতার পুনরুত্থানে হুমকির মুখে পড়েছে। খোদ ইউক্রেন সংকট আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার গভীর কাঠামোগত সমস্যার একটি উপসর্গ হিসেবে দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের (চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র) নেতৃত্বে এই বৈশ্বিক ব্যবস্থাটি জাতিসংঘের সনদে অন্তর্ভুক্ত সুশাসনের নীতিগুলো সবখানে বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। নতুন বৈশ্বিক ব্যবস্থা প্রধান প্রধান যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্রে বিজয়ী পক্ষগুলো এক হয়ে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য বিশ্বব্যবস্থার বিদ্যমান কাঠামোর নকশা করেছিল। যদিও জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমাদের আন্তসংযুক্ত বিশ্ব নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, তথাপি আমাদের সাংগঠনিক নীতিগুলো এখনো যুদ্ধ-পরবর্তী এবং শীতল যুদ্ধের যুগের মানসিকতাকে প্রতিফলিত করে চলেছে। বর্তমান বৈশ্বিক কাঠামোটি আমাদের এমন এক ব্যবস্থার মধ্যে রেখেছে, যেখানে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যর্থ হওয়া মানে সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থ হওয়া। প্রশ্ন হলো, এই ব্যবস্থাকে কি সংস্কার করা যাবে? রাশিয়া ও চীন এখন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার নেতৃত্বের আসনে বসে বিশ্বকে আরও বিভক্তিভিত্তিক ব্যবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বর্তমান কাঠামোর সংস্কারকাজ করার পরিবর্তে তারা এর বৈধতাকেই চ্যালেঞ্জ করছে।
সাবেক থাই প্রধানমন্ত্রী আনন্দ পানিয়ারচুনের সভাপতিত্বে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ১৬ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ে গঠিত জাতিসংঘের একটি প্যানেল আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সমসাময়িক হুমকিগুলো বিশ্লেষণ করেছে। তারা বিদ্যমান নীতি এবং প্রতিষ্ঠানগুলো সেই হুমকিগুলো মোকাবিলায় কতটা ভালো করেছে, তা মূল্যায়ন করেছে। এ ছাড়া প্যানেলটি জাতিসংঘকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে এবং একবিংশ শতাব্দীর জন্য সম্মিলিত নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য জাতিসংঘকে সক্ষম করার লক্ষ্যে সুপারিশ পেশ করেছে। প্যানেলের চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি স্পষ্ট করে দিয়েছে, নিরাপত্তা পরিষদসহ জাতিসংঘের সব প্রধান অঙ্গের সংস্কার প্রয়োজন। প্যানেলের যুক্তি ছিল, জাতিসংঘের আরও প্রসারিত হওয়া উচিত। দুর্ভাগ্যবশত, নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো দিতে সক্ষম স্থায়ী সদস্যরা প্যানেলের সুপারিশগুলোকে উপেক্ষা করে আজকের পক্ষাঘাতগ্রস্ত এবং অকার্যকর মঞ্চ তৈরি করেছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি সত্যিকার অর্থে কার্যকরী ও প্রতিনিধিত্বশীল জাতিসংঘ ব্যবস্থার প্রয়োজন। জাতিসংঘের অতীতের অন্যায্য একচোখা নীতির কারণে মধ্যপ্রাচ্যের চেয়ে আর কোনো অঞ্চলই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। আমরা হলাম সেই বেদি, যেখানে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার নীতিগুলোকে নিয়মিতভাবে বলি দেওয়া হয়। যে আন্তর্জাতিক নীতির কারণে ইসরায়েল রাষ্ট্রের সৃষ্টি করেছিল, সেই একই নীতির কারণে ফিলিস্তিনিরা তাদের স্বদেশ থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং তাদের স্বনিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যকে এক যুদ্ধ থেকে অন্য যুদ্ধে, এক বিপর্যয় থেকে অন্য বিপর্যয়ে যেতে হয়েছে; জাতিসংঘের এক প্রস্তাব থেকে অন্য পাস হয়েছে, কিন্তু ন্যায়বিচার থেকে মধ্যপ্রাচ্য ক্রমাগত বঞ্চিত হয়েছে। যখনই একটি আরব, মুসলিম বা মধ্যপ্রাচ্যের ইস্যু উঠে আসে, তখনই আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার নেতৃত্বদানকারী মহা শক্তিগুলোর ভণ্ডামি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেই ক্ষমতাধর নেতাদের এখন হুঁশে আসা দরকার। বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থার সংস্কারের বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যসহ জাতিসংঘের সব সদস্যরাষ্ট্রের নতুন চিন্তাভাবনা প্রয়োজন। যে বিশ্বব্যবস্থা মানবতার মুখোমুখি হওয়া চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ন্যায়সংগত এবং সক্ষম ভূমিকা রাখতে পারে, কেবল সেই ব্যবস্থাকেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
লেখক কিং ফয়সাল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজের চেয়ারম্যান।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct