ত্যাগ
গোলাম মোস্তাফা মুনু
উনজেলা বিবি মোবাইল ফোনে স্বামীকে জিজ্ঞাসা করে, ‘হ্যালো, কুরবানির আর দশটা দিন বাকি রয়েছে। তুমি আসবে কখন আর কুরবানির পশু কিনবেই বা কখন?’ ‘অন্যান্য বারের মতো এবার ভালো রোজগার হয়নি। হাতে এখন রয়েছে মোট বারো হাজার টাকা। ভাবলাম, আর দু-চারটা দিন থেকে যায়। এ কটা দিনে যদি হাজার দেড়েক টাকাও রোজগার করতে পারি তো খুব কাজের কাজ হবে।’ ফোনের ওপার থেকে বলল হাজিউল ইসলাম। স্ত্রী উনজেলা বিবি একই রকম সুরে বলে, ‘ছেলে মেয়ে বড় আশা করে বসে আছে। ওরা রোজ জিজ্ঞাসা করছে ‘আব্বা কখন আসবে’। গ্রামের প্রায় সবারই কুরবানির পশু কেনা হয়ে গেছে। ওদের ছেলে মেয়েরা কুরবানির পশু পেয়ে কত খুশি আছে।’ স্ত্রীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে হাজিউল বলে ওঠে, ‘আমি বাড়ি আসি, ওরাও খুশি হবে। কুরবানির পাঁচ-ছয়দিন পূর্বেই আমি বাড়ি পৌঁছে যাবো। ওদেরকে বলে দাও।’ ‘ঠিক আছে। আর শোনো, রাস্তাঘাটে দেখে শুনে আসিও।’ বলে উনজেলা ফোন রেখে দেয়। হাজিউল ইসলাম খেটে খাওয়া মানুষ। ভিন রাজ্যে গিয়ে কাজ করে। অন্যান্যদের মতো সে বেশি খাটতে পারে না তাই রোজগারও তার বেশি হয় না। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। আট মাস হলো। বহু দেনাও হয়ে গেছে। কয়েকজনের কাছে। খেটে খেটে শোধ দিচ্ছে। তাই সে বাড়িতে বেশি দিন থাকতে পায় না। বাইরে গিয়ে কাজ করাতেই ব্যস্ত থাকে। হাতে আর পাঁচ দিন বাকি। গত রাত্রেই বাড়ি ফিরেছে হাজিউল ইসলাম। ছেলেমেয়ে তখনও ঘুমিয়েছিল। ছেলের বয়স দশ আর মেয়ের সাত। সকালে বিছানা ছেড়েই ছেলে মাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আম্মা, আব্বা কখন বাড়ি আসবে?’ উনজেলা বিবি বারান্দায় ঝাড়ু লাগাতে লাগাতেই বলে, ‘তোর আব্বা আজ রাত্রে চলে এসেছে। ওই ঘরে শুয়ে আছে।’ মায়ের কাছে এমন খুশির খবর পেয়ে ছেলে খুশিতে ছুটে যায় বাবার কাছে। বাবার বাড়ি ফেরার খবরটা মেয়ের কানে পৌঁছলে সেও বিছানা ছেড়ে বাবার কাছে ছুটে যায়। ছেলেমেয়ে খুশিতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। বাবা হাজিউল তখনও ঘুমের মধ্যে ছিল। ছেলেমেয়ের ভালোবাসার আলিঙ্গনে সে জেগে যায়। ছেলেমেয়েকে আদর দিতে শুরু করে। খানিক পরেই ছেলে বাবাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আব্বা, কুরবানির খাসি কিনবা না মেয়ে বলে, ‘সবার কেনা হয়ে গেছে। শুধু আমাদেরই বাকি।’ ছেলেমেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাজিউল হাসিমুখে বলে, ‘কিনবো রে বাবা কিনবো, আজকেই কিনবো।’ ‘তবে আর দেরি করো না আব্বা। এখনই কিনতে যাও।’ ছেলে বলে উঠলো। হাজিউল ইসলাম হাতমুখ ধুয়ে সকালের জলখাবার না খেয়েই বেরিয়ে যায় কুরবানির পশু কেনার উদ্দেশ্যে। গ্রামের শেষে আম বাগানে প্রায় প্রতিদিনই কুরবানির উদ্দেশ্যে গরু-ছাগলের হাট বসছে। দূর থেকেও গাড়ি করে গরু-ছাগল নিয়ে আসছে পাইকারেরা। হাজিউল সেখানেই যায়।
এদিকে কুরবানির পশুকে খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে কোথা থেকে ঘাস কেটে নিয়ে আসে হাজিউলের ছেলে-মেয়ে। তারা অধীর আগ্রহে বাবার অপেক্ষা করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর মাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আব্বা এত দেরি করছে কেন আম্মা? হাটে কি গরু-ছাগল নেই?’ ‘আসছে রে আসছে। একটু দেখে-শুনে কিনতে হবে না? সময় তো লাগবেই।’ বলে উনজেলা বিবি নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঘন্টা তিনেক পর। হাজিউল বাড়ি ফেরে। ছেলে বাবাকে খালি হাতে দেখে জিজ্ঞাসা করে, ‘আব্বা, খাসি এখন আনলে না কেন? ওর জন্য যে আমরা ঘাস কেটে এনেছি!’ হাজিউল কোনো জবাব না দিয়ে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। স্ত্রী উনজেলা স্বামীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, কী ব্যাপার? আজকে কিনলে না কেন?’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাজিউল বলে, ‘টাকার অভাবে।’ ‘তুমি তেরো হাজার টাকা নিয়ে গেলে যে?’ ‘নিয়ে গিয়েছিলাম ঠিকই উনজেলা, তবুও কেনা হল না। হাটে দেখা হয়ে গেল নাসিদুরের সাথে। সে চৌদ্দ হাজার টাকা পেত। বড় মেয়ের বিয়েতে ধার নিয়েছিলাম তা তো তুমি জানো। বেশ কয়েকবার কথা দিয়ে কথা রাখতে পারিনি। বিরক্ত হয়ে গেছে। আজকে যদি টাকাটা না দিতাম তাহলে হয়তো বেইজ্জত করে দিত। তেরো হাজার সবটাই দিয়ে দিলাম। ভাবলাম, আমরা গরিব, কুরবানি না করলেও আমাদের পাপ হবে না। কুরবানি না করে সেই টাকাগুলো দিয়ে যদি একজন পাওনাদারকে শোধ দিতে পারি তো এটাই হবে নেকির কাজ।’উনজেলা মন খারাপ করে ছেলেমেয়ের হাত ধরে ঘরের ভেতর চলে যায়। আর হাজিউল ইসলাম সেখানেই দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করে কী যেন ভাবতে থাকে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct