অপেক্ষার ঈদ
মোঃ আব্দুর রহমান
“ঈদজ্জোহার চাঁদ হাসে ঐ/এল আবার দুসরা ঈদ/ কোরবানী দে কোরবানী দে/শোন খোদার ফরমান তাকীদ’।” কথাটি লিখেছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সত্যিই বছর ঘুরে আবার এসেছে, মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় মহা উৎসব বহু আকাঙ্খিত ঈদুল আজহা।যেই দিনটির জন্য অপেক্ষায় ধ্বনি-গরীব সবাই। তবে শ্রেনীভেধে আশার মাঝে আছে ভিন্নতা।আসলে এই ঈদে আনন্দঘন মুহূর্ত যেমন রয়েছে, পাশাপাশি আছে দায়িত্ব পালনের এক গুরত্বপূর্নবার্তা। আর সেটা হলো কুরবানি। কেউ চায় কুরবানি দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে আবার কেউ আশায় থাকে একটু মাংস খেতে। তাই ঈদের মহাখুশিতে প্রথমেই জানাযাক কোরবানি কি? “ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য অর্জন ও ইবাদতের জন্য পশু জবেহ করাকে কুরবানি বলা হয়।” আশারাখি কুরবানি কি, সেটা সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি। তবে সংজ্ঞার পাশাপাশি এবার জানা প্রয়োজন আমাদের করনীয় সম্পর্কে। হ্যাঁ পাঠক বন্ধুরা, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার নবীকে কুরবানি করতে নির্দেশ দিয়েছেন-” আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্য সালাত আদায় করুন ও কুরবানি করুন।” (সূরা কাওসারঃ ২) আশারাখি আমরা আমাদের করনীয় সম্পর্কে ইতিমধ্যেই অবগত হয়েছি। এ প্রসঙ্গে পরিস্কার বলা যায়, সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্য কুরবানি করা ওয়াজিব। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ এবং রাসুলে করিম(সাঃ)-এর দায়েমী আমলী সুন্নাত। এমনকি নবী করিম (সা.) মদীনায় দশ বছর অবস্থানকালে প্রতিবছর কুরবানি করেছেন এবং সাহাবিদের কুরবানি করার নির্দেশ দিয়েছেন। এখানে আরও একটু বলা যায়,” ১০ যিলহাজ্জের ফজর থেকে ১২ যিলহজ্জের সন্ধ্যা পর্যন্ত অর্থাৎ, কুরবানির দিনগুলোতে যার নিকট সদকায়ে ফিতর/ফিতরা ওয়াজিব হওয়া পরিমান অর্থ/সম্পদ থাকে তার উপর কুরবানি করা ওয়াজিব।তাহলে আমাদের কার উপর কুরবানি দেওয়া ওয়াজিব,সেটাও নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছি। আর কুরবানির গোশত ভাগের ক্ষেত্রে মুস্তাহাব ও উত্তম পদ্ধতি হলো -এক ভাগ নিজেদের জন্য রেখে, একভাগ আত্মীয়স্বজন এবং আর একভাগ মিসকিনদের মাঝে দেয়া।
এবার একটু যাওয়া যাক কেন তিনভাগে ভাগ করে দিবো। প্রথমেই আসাযাক মিসকিনদের কথায়। বাস্তবতার নিরিখেই যদি আমরা লক্ষ্য করি এদেশের অসহায় গরীব-দুস্তদের কথা।যারা না খেয়ে দিনের পর দিন রেললাইনে, বস্তিতে, পথে অনাহারে দিন কাটায়। তারা কোথায় পাবে মাংস! রোদ-বৃষ্টি-শীতের সাথে জীবনযুদ্ধেই যারাব্যস্ত! তারা কিভাবে খাবে! তাইতো সেসব ক্ষুধার্থ চোখগুলি অপেক্ষায় থাকে শুধু কুরবানি ঈদের..। সেক্ষেত্রে তাদের শূন্য হাতে অবশ্যই ফিরানো উচিৎ নয়। এছাড়াও মানুষ সামাজিক জীব। পারস্পরিক সম্পর্ক ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারেনা। আমাদের অনেক আত্মীয়স্বজন বা প্রতিবেশী আছে, তাদেরও হক আছে কুরবানির এই মাংসের উপর। তারা মুখে না বললেও হয়তো মনে মনে আশা করে। তাই আমাদের উচিৎ তাদেরকেও মাংসটুকু সসন্মানে পৌঁছে দেওয়া।সুপ্রিয় পাঠক,আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান দেশ। গাঁয়ের কৃষকসহ বর্তমান যুগে বিভিন্ন গ্রামে-শহরের খামারেও গবাদী পশুপালন করা হয়। বছর শেষে কুরবানিতে পশুগুলিকে হাটেও তোলা হয়। এতে কৃষকরা যেমন অার্থিকভাবে লাভোবান হয়, তেমনি ক্রেতারাও পছন্দমতো পশু কুরবানির জন্য সংগ্রহ করে। তবে এখানে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের উচিৎ সন্তষ্ট থেকে বেঁচাকেনা করা। কেউ সুযোগে সদ্বব্যবহার করার চেষ্টা করা কোনভাবেই কাম্য নয়। যেমনঃ কোন অসুস্থ্য গরু বিক্রি না করা বা কান নেই এমন কোন পশুরবিক্রি না করা। আবার ক্রেতাদেরও উচিৎ অবশ্যই বিক্রেতাকে ন্যায্য দাম দেওয়ার চেষ্টা করা।পাশাপাশি কুরবানির দিন যেসকল লোকজনকে কসাই হিসেবে মাংস কাটার জন্য আনা হয়,অবশ্যই তাদের মাংস না দিয়ে ন্যায্য পারিশ্রমিক বুঝিয়ে দিতে হবে।
এবার আসি শিশুদের কথায়। শিশুদের মন ফুলের মতো পবিত্র। ওরা ঈদে নতুন জামা-কাপড় পড়ে,কোরবানির পশুটাকেও দেখতে ও মাংস বিলাতে সারাবছর অপেক্ষায় থাকে। তাই সামর্থ্যবান মা-বাবার উচিৎ কুরবানি দিয়ে ওদের আশাটা পূরণ করা। এতে ভবিষ্যতে ওরাও কুরবানির শিক্ষাটা ভালোভাবে রপ্ত করতে শিখবে। কুরবানি সম্পর্কে বলতে হয়, কুরবানি অবশ্যই ঈদের নামাজের পর দিতে হবে। নিজের কুরবানি পশু নিজেই জবেহ করা অথবা জবেহ করার সময় উপস্থিত থাকা উত্তম। কমপক্ষে বকরি, খাসি, ভেড়া, দুম্বা-১ বছর। গরু-মহিষ-২ বছর এবং উটের বয়স ৫ বছর হতে হবে। এর চাইতে কম বয়সের গবাদি পশু কুরবানি না দেয়া। আর বকরি, খাসি, ভেড়া এক জনের নামে এবং গরু, মহিষ ও উটের ক্ষেত্র সাতজন শরীক হতে পারে। তবে সাতজন শরীক জরুরি নয়। উপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বছর ঘুরে অপেক্ষার পর- আবার কুরবানির ঈদ এলো। তাই আমাদের সকলকে সামর্থ্য অনুযায়ী ঈদের আনন্দটুকু স্বতঃস্ফূর্ত ভাগাভাগি করে নিতে হবে, পাশাপাশি আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে হবে। আর কবির কথাটাও মনে রাখা উচিৎ,” আজই সকল ধরার মাঝে বিরাট মানবতা/ মানবতার মূরতি লোভিয়াছে হর্ষে/ আজকে প্রাণে প্রাণে যেভাবে জাগিয়েছে, রাখতে হবে সারা বর্ষে। আল্লাহ আমাদের ঈদ এবং কুরবানি কবুল করুক। আমীন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct