মধ্যপ্রাচ্যে ন্যাটো ধরনের আরব প্রতিরক্ষা জোট গঠনের বিষয় হঠাৎ করে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। জর্দানের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লাহ গত শুক্রবার বলেছেন, তিনি পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর মতো মধ্যপ্রাচ্যে একটি সামরিক জোটকে সমর্থন করেন। সিএনবিসির সাথে কথা বলার সময়, বাদশাহ আবদুল্লাহ বলেছেন, এ জাতীয় জোটের সনদ খুব স্পষ্ট হওয়া দরকার। যারা মধ্যপ্রাচ্যে ন্যাটোকে সমর্থন করবে, তবে বাকি বিশ্বের সাথে সংযোগ রাখবে তা খুব স্পষ্ট হতে হবে। এ লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ শেষ কিস্তি।
এধরনের সঙ্ঘাতমুখর অবস্থার অবসানের জন্য বিরোধের বিষয়গুলো এক পাশে সরিয়ে ঐক্যের সূত্র নিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়ার একটি উদ্যোগ চলমান ছিল। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর সৃষ্ট পরিস্থিতিতে এখন মধ্যপ্রাচ্যও যেন পাল্টে যাচ্ছে। ইরাক গত এক বছরে রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যে পাঁচ দফা আলোচনার আয়োজন করে। ইরাকি প্রধানমন্ত্রী মোস্তফা আল-কাদিমি সম্প্রতি ইরানি প্রেসিডেন্ট ও সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। সরকারি সৌদি প্রেস এজেন্সি জানিয়েছে, প্রিন্স মোহাম্মদের সাথে কাদিমির বৈঠকের সময় দু’জন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও যৌথ সহযোগিতার সুযোগ নিয়ে কথা বলেছেন। রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যকার এই আলোচনা সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক মেরামত এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করার সঠিক পথে ফিরে আসার জন্য একটি রোড ম্যাপ উপস্থাপন করেছে। এতে মনে হয়, নিরাপত্তা জোটের লক্ষ্য কেবলই ইরান নয়। ইরানের বিরুদ্ধে জোট করার প্রচেষ্টা ইসরাইল ও সৌদি আরব দুই দেশেরই রয়েছে। তবে ইরান যদি তার পারমাণবিক উৎপাদনে পাইকারি হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে তা হবে তার নিকটবর্তী প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে, ইসরাইলের বিরুদ্ধে নয়। ইরানের কোনো প্রতিবেশী এ ক্ষেত্রে প্রলুব্ধ হবে কি না তা দেখার বিষয়। যদি তারা তা করে তবে তাদের সর্বোচ্চ আত্মবিশ্বাসী হতে হবে যে তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ছাতা তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হবে না। ইরানই একমাত্র উপসাগরীয় রাষ্ট্র, যারা পরাশক্তির হার্ডওয়্যার ছাড়াই নিজেকে রক্ষা করতে পারে। সিরিয়ার শান্তি প্রক্রিয়ার পরিণতি লাভ সম্ভব হচ্ছে না ইরানের এক ধরনের প্রান্তিক অবস্থানের কারণে। নানা স্বার্থগত ইস্যুতে ইরান-তুরস্ক মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কাও সৃষ্টি হচ্ছে। তুরস্কও অভ্যন্তরের পরিস্থিতির প্রতি নানাভাবে মনোযোগী হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট এরদোগান এখন যা কিছু করছেন তা আগামী বছরের নির্বাচনের প্রস্তুতিকে সামনে রেখে। হাইপারইনফ্লেশনে বিপর্যস্ত জনগণের কাছে এরদোগানকে দু’টি জিনিস প্রমাণ করতে হবে যে, তুরস্ক আর প্রধান আরব শক্তির সাথে যুদ্ধে নেই এবং তিনি অর্থ আনতে পারেন।
এ ধরনের এক অবস্থায় সুন্নি আরব দেশগুলো আর ইসরাইল মিলে ইরান বিরোধী কোনো নতুন সামরিক জোট দাঁড়ালে মধ্যপ্রাচ্যের চিত্র পাল্টে যেতে পারে। ট্রাম্পের সময় আরব ন্যাটো নামে তেমন একটি জোটই সৃষ্টি করার উদ্যোগ ছিল। সেই বাস্তবতা কিন্তু এখন নেই। ইরান বিরোধিতা এবং পরমাণু চুক্তি থেকে প্রত্যাহার প্রশ্নে ট্রাম্প আর বাইডেনের দৃষ্টিভঙ্গিও এক নয়। পরমাণু চুক্তি ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে ইরানের সাথে পাশ্চাত্যের সমঝোতা জোরালোভাবে না এগোলেও তা বন্ধ নেই। নতুন করে দুই পক্ষ পরোক্ষ বৈঠকে বসেছে। এতে ইরানের পরমাণু শক্তিধর দেশ হওয়ার আকাক্সক্ষা অবরোধ প্রত্যাহারের শর্তে বাদ দেয়ার সমঝোতার কথা জানা যাচ্ছে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সাথে ইরানের পরমাণু সমঝোতা হলেই যে, দেশটি আমেরিকান বলয়ে ঢুকে যাবে এমনটি নয়। তবে ইরানি প্রভাব মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে এতে অনেক বাড়বে। সেই প্রভাব থেকে নিরাপত্তার জন্য শীর্ষ সুন্নি আরব অনারব দেশগুলো একটি সামরিক জোট গঠনের প্রয়োজন অনুভব করছে বলে মনে হয়। পরমাণু ইস্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সাথে সমঝোতার পর মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ভূমিকাকে রাশিয়া-চীন কতটা কিভাবে সমর্থন করে তা নিয়ে কিছুটা প্রশ্ন রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার ভূমিকাও এক ধরনের সীমাবদ্ধতায় আটকে আছে। ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করে যতটা তিনি চিবিয়ে খেতে পারেন তার চেয়ে বেশি কামড়ে ফেলেছেন বলে মনে হয়। তাকে সিরিয়া থেকে ইউনিট প্রত্যাহার করতে হয়েছে এবং লিবিয়া থেকে ওয়াগনার ভাড়াটে সেনাদের পুনরায় মোতায়েন করতে হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে রাশিয়ার ফোকাস এতে নিশ্চিতভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইরানের সাথে আমেরিকান সমঝোতার পর পেছন থেকে চীন রাশিয়া সরে দাঁড়ালে এই শক্তিমান মুসলিম দেশটি তার অবস্থান হারাতে পারে। আর ইরানের মধ্যপ্রাচ্যে গ্রাউন্ড হারানোর অর্থ হবে একই সাথে ফিলিস্তিন ইস্যুতে জোরালো সমর্থনও হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। আরব ন্যাটোর কোনো মিত্র দেশ অথবা ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনকারী তুরস্কের মতো কোনো রাষ্ট্র ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইরানের মতো সমর্থন জোগাতে পারবে না। ফলে ‘আরব ন্যাটো’ জোটের সামনে ইরান শক্তিমত্তা হারানোর অর্থ শুধু দেশটি দুর্বল হবে এমন না, একই সাথে ফিলিস্তিন প্রতিরোধ আন্দোলনও দুর্বল হয়ে পড়বে। (সমাপ্ত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct