মধ্যপ্রাচ্যে ন্যাটো ধরনের আরব প্রতিরক্ষা জোট গঠনের বিষয় হঠাৎ করে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। জর্দানের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লাহ গত শুক্রবার বলেছেন, তিনি পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর মতো মধ্যপ্রাচ্যে একটি সামরিক জোটকে সমর্থন করেন। সিএনবিসির সাথে কথা বলার সময়, বাদশাহ আবদুল্লাহ বলেছেন, এ জাতীয় জোটের সনদ খুব স্পষ্ট হওয়া দরকার। যারা মধ্যপ্রাচ্যে ন্যাটোকে সমর্থন করবে, তবে বাকি বিশ্বের সাথে সংযোগ রাখবে তা খুব স্পষ্ট হতে হবে। এ লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ চতুর্থ কিস্তি।
এধরনের কোনো সামরিক ব্লক গঠন অবশ্য সহজ কোনো কাজ নয়। এ অঞ্চলে এক দিকে রয়েছে আমেরিকা ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের বিশেষ প্রভাব। আর অন্য দিকে রাশিয়ার সরাসরি সামরিক উপস্থিতিও রয়েছে এ অঞ্চলে। চীনের রয়েছে ব্যাপক বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্পর্ক। ফলে এক ধরনের বোঝাপড়া ছাড়া কোনো সামরিক জোট গঠন এই অঞ্চলে করা কঠিন। তবে যেসব দেশকে নিয়ে এই জোট গঠনের কথা বলা হচ্ছে সেসবের কোনো দেশই রুশ-চীন বলয়ের নয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই দুই দেশের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক তারা সৃষ্টি করেছে। এ অবস্থায় সামরিক জোট গঠন এখন একেবারে অসম্ভব কোনো বিষয় সম্ভবত হবে না। আর যুক্তরাষ্ট্র তার নিজস্ব সমীকরণের কারণে এই জোটে বাধা হওয়ার সম্ভাবনা কম। আর ইরান চাইলেই এ জোটটিকে বাধা দেয়ার অবস্থায় রয়েছে বলে মনে হয় না।
ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির নিকটবর্তী পূর্ব ও দক্ষিণ এশীয় কেন্দ্রের ডেভিড ডেস রোচেসের মতে, একটি আরব ন্যাটো বা এমনকি একটি উপসাগরীয় ন্যাটোর ধারণারও তিনটি সমস্যা রয়েছে, যা এ ধরনের জোট গঠনকে কঠিন করে তুলবে। এই অঞ্চলে মিশরের জনসংখ্যা বরাবরই এত বড় যে, এটি যেকোনো জোট গঠনে প্রাধান্য পাবে। সৌদি আরব জিসিসির অভ্যন্তরে মোটামুটি একই ভূমিকা পালন করে। লোকেরা যখন উপসাগরের দিকে তাকায় এবং ন্যাটো ব্যবস্থার আহ্বান জানায়, তখন এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল ও গ্রিস সমন্বিত ন্যাটো হলে যে রকম হয় তেমন কিছু হতে পারে। দেশগুলোর আকার এতই আলাদা যে, সত্যিকারের জোট করা কঠিন। দ্বিতীয় সমস্যাটি হবে ইসরাইলের ভূমিকা। ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমস্যা সবসময় এ ধরনের ব্যবস্থাকে জটিল করে তুলবে। ডেস রোচেসের মতে, তৃতীয় সমস্যাটি হলো এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে আস্থার অভাব। এক সময় আরব জোটগুলোর প্রধান লক্ষ্য থাকত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও ইসরাইলি দখলদারিত্ব থেকে আরব ভূমি মুক্ত করা। এখন জোট গঠনের লক্ষ্যবস্তু পাল্টে গেছে। এখন ইরানকে প্রতিরোধ বা ধ্বংস করতে প্রতিরক্ষা জোট গঠনের কথাও বলা হচ্ছে যে জোটে ইসরাইলের পাশাপাশি থাকবে আরব দেশগুলোও। এ ধরনের একটি পরিস্থিতি কেবলই আরব রাজাদের ইহুদি তোষণের মাধ্যমে ক্ষমতা নিরাপদ রাখার কারণে হচ্ছে, মনে করার কারণ নেই। একই সাথে, সৌদি আরবের রাষ্ট্রিক নিরাপত্তা ও রাজপরিবারের ক্ষমতার ঝুঁকি সৃষ্টির মতো প্রক্সি হামলাও এ জন্য কম দায়ী নয়।
মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য কার ভূমিকা কতটুকু দায়ী তার চেয়ে বড় বিষয় হতে পারে এ ধরনের সঙ্ঘাতের পর মধ্যপ্রাচ্যের চেহারাটি কেমন হবে। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে দু’টি পরিকল্পনার বিষয় এক সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এর মধ্যে একটি ছিল ইনোন পরিকল্পনা ও বৃহত্তর ইসরাইল গঠন। দ্বিতীয়টি ছিল নতুন মধ্যপ্রাচ্য সৃষ্টির মানচিত্র। একটির পেছনে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের পরিকল্পনা থাকলেও দ্বিতীয়টির মূল পরিকল্পক হিসেবে দেখা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। দু’টি পরিকল্পনা মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেললেও চলতি শতকের প্রথম দিকের নতুন মধ্যপ্রাচ্য পরিকল্পনাটি সরবে বা নীরবে বেশি আলোচিত হয়। এ পরিকল্পনা প্রকাশের পর আরব বসন্ত থেকে শুরু করে এমন কিছু ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটতে থাকে যাতে মধ্যপ্রাচ্যের বিদ্যমান জাতি রাষ্ট্রগুলোর অখণ্ডতা হুমকির মধ্যে পড়ে যায়। সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, ইয়েমেন কার্যত কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণবিহীন একাধিক খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সেই বিভক্তির ক্ষত এখনো বয়ে চলেছে। অন্য দিকে অন্য দেশগুলোও অভ্যন্তরীণ ও ছায়া সঙ্ঘাতের নানা ঘটনায় বিধ্বস্ত হওয়া অথবা অস্থিরতা সৃষ্টির হুমকির মধ্যে পড়েছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct