সমাজব্যবস্থায় পণপ্রথার অবস্থান
ক) পরিবার : একটি দরিদ্র পরিবারের পিতা যখন সংসার অনটনে ব্যস্ত থাকে, কন্যাসন্তানের জন্মানোর পর আরেকটা যুক্ত হয় পণপ্রথার যন্ত্রণা। জীবনের মৌলিক চাহিদা খাদ্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের সঙ্গে সঙ্গে এই সামাজিক ব্যাধির সঙ্গেও লড়তে থাকে। এই ব্যাধির যন্ত্রনা এত বেশি যে অন্যান্য মৌলিক চাহিদা গুলো আর পূরণ হতে পারেনা । এক দিকে যেমন আর্থিক ভাবে শিকার হয় তেমনি মানসিক ভাবেও শিকার হয়। কন্যাসন্তান বেড়ে ওঠার সাথে সাথে পিতার মানসিক যন্ত্রনাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। যার ফলে মেয়ের বয়স পনেরো হতে না হতেই বিয়ের শানাই বাজতে শুরু করে দেয়। অনেক পরিবারেও এরকম শোনা যায় “মেয়েটা বড়ো হয়েছে এবার বেঁচতে হবে”। এই মানসিক যন্ত্রনা অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী হয় যখন সেই মেয়েটি বিয়ের পরে শশুর বাড়িতে পনের জন্যে জ্বালা যন্ত্রণার ঘানি টেনে ক্লান্ত হয়ে আত্মঘাতী হয়। এবং একজন মা তার মেয়ে কে দশ বছর বয়স হতেই তাকে বিয়ের জন্যে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে সাংসারিক বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে। এরকম ভাবে মন্তব্যও শোনা যায় “কি রে,ঠিকঠাক ভাবে রান্না করতেও পারিস না, শশুর বাড়িতে যখন যাবি তখন কি করবি ? শশুর বাড়ির লোকে কি বলবে? যে মেয়েটিকে কিছুই শিখে পাঠাইনি ?” । আর ঠিক দশ থেকে বারো বছর বয়স হতে না হতেই সেই মেয়েটি পরিচিত হয় এই সামাজিক কুপ্রথার সাথে। তার শৈশব কাল পেরোতেই জীবনের সঙ্গে যুক্ত হয় নতুন আরেকটা মানসিক চাপ। মনে মনে বিভিন্ন প্রকার কৌতূহল উঁকি মারে-” আচ্ছা আমাকে বেচা হবে ! আমি কি তাহলে একটা দায়বদ্ধতা ! একটা ছেলেকে আমার জন্যে কিনতে হবে ! আমরা তো গরিব আমার বাবা তাহলে কি করবে !” ঠিক এরকম অবস্থায় যখন কৈশোর বয়সে পা রাখে , তখন ঘরোয়াভাবে বিভিন্ন অর্থ-উপার্জনকারী কাজে যেমন বিড়ি বাঁধা, জরিক, জামা-কাপড় সেলাই করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অর্থ জোগাতে থাকে। তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় এই গোছানো অর্থ দিয়ে তুমি কি করবে ? সে উত্তর দেয় “কেনো আমার বিয়েতে সোনার গহনা কিনবো” আশ্চর্যের বিষয় যে, সেই মেয়েটির উত্তর কখনোই এরকম হয়না যে আমি পড়াশুনার জন্যে খরচ করবো বা আমার পার্সোনাল কেয়ার ( যেমন-স্যানিটারি প্যাড ) এ কাজে লাগাবো। মেয়ে জন্মালেই মা বাবার মাথায় আসে বিয়ে দিতে হবে, অন্যদিকে ছেলে জন্মালে আমার ছেলে ডাক্তার হবে, অমুক হবে আরও কত কি । পুত্র সন্তানের পিতা-মাতা কি কখনো তাকে এ শিক্ষা দেয় যে নতুন একটা মেয়ে বিশ বছর বাবার বাড়িতে থেকে একজন বৌ হিসেবে আসবে তাকে কিভাবে গ্রহণ করতে হবে , তার আত্ম-সম্মান কে কিভাবে শ্রদ্ধা করবে, নতুন পরিবারের কৃষ্টি- সংস্কৃতিকে কিভাবে মানিয়ে নেবে?
খ) সহপাঠি দল : ছেলে-মেয়ে বড়ো হওয়ার সাথে সাথে যখন বন্ধু-বান্ধবের গ্রুপ এ মিশে যায় তখন একে অপরকে বিয়ের সময় জিজ্ঞেস করে পনের জন্যে, যেটি একটি খুব অবমাননাকর আলোচনার বিষয়। আমরা খুব হাসি মুখেই জিজ্ঞেস করি “ কি রে বিয়েতে কি পেলি শশুর বাড়ি থেকে ? আর মেয়ে হলে “ কি রে তোর বাবা তোর বিয়েতে কি দিলো ?” । আমাদের চিন্তা ভাবনা ঠিক “দেওয়া-নেওয়াতেই” সীমাবদ্ধ থেকে যায়। কিন্তু কেন ? আমাদের এরকম চিন্তা ভাবনার জন্ম কোথা থেকে হচ্ছে ?
গ) সমাজ : আজকের সমাজ ব্যবস্থায় পণপ্রথাটা নতুন বেশ ধারণ করেছে, যেটাকে চোরাপন ও বলা হয় অর্থাৎ আমরা সরাসরি দাবি করিনা কিন্তু পণ দেওয়ার সামর্থ্য আছে এরকম পরিবারে সম্বন্ধ রাখতে চাই। এই প্রথাটা যে শুধু পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর মধ্যে আছে তা নয় বরং উচ্চ-বিত্ত শিক্ষিত পরিবারেও খুব স্পষ্ট ভাবে দেখা যায়। সুতরাং, বৈবাহিক সম্পর্কটা আজকে ‘বিবাহ-বাজার’ এ পরিণত হয়েছে যেখানে শুধু লেনা-দেনার হিসাব চলে। এই প্রথাটা আমাদের সমাজ ব্যবস্থার অতীব সাধারণ প্রথা হিসেবে চালু হয়ে গেছে। ছেলে-মেয়ের সম্বন্ধ দেখার আর বত্রিশ গুণ নেই বরং তেত্রিশটি হয়ে গেছে । যেটি আমরা একে ওপরের দেখে শিখছি বা শিখতে বাধ্য হচ্ছি। নীলকর সাহেবদের মতো নীল চাষ না করলেও করাবে অর্থাৎ পণ দেওয়ার সামর্থ না থাকলেও দিতে হবে। যার কারণে রবি ঠাকুরের নিরুপমার মতো হাজারো নিরুপমা আজও আমাদের সমাজে পনের আগুনে জ্বলছে। জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো হিসেবে আমাদের দেশে প্রতিদিন গড়ে ১৯ জন মহিলা প্রাণ ত্যাগ করে। পশ্চিমবঙ্গ ২০২০ সালে চতুর্থ স্থানে ছিল।
সুতরাং, এই স্বল্প আলোচনার ভিত্তিতে বুঝতে পারছি যে এই কুপ্রথাটা সমাজের প্রত্যেক স্তরে ধনী- গরিব নির্বিশেষে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত হয়ে আছে। সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে বিভিন্ন রূপে এই প্রথাটি প্রতিফলিত হচ্ছে। এটা আমাদের বোধগম্য হয়েছে যে পণ দেওয়া বা নেওয়া গর্বের বিষয় নয় বরং এটা খুব লজ্জাজনক ব্যাপার। পণ নেওয়ার মাধ্যমে একটি পরিবার অর্থাৎ নিজের আত্মীয়কে দারিদ্রতার বেড়াজালে বেঁধে দিচ্ছি। তাই এই পুরুষতান্ত্রিক মনভাবকে কাটিয়ে চিরন্তন বন্ধনের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত। ‘বিবাহ-বাজার’ এ একটা মেয়ের পরিবার যখন শিকার হচ্ছে, সেক্ষেত্রে উচ্চ-শিক্ষার জন্যে মেয়েদের কে আরও বেশি প্রোৎসাহিত করা এবং বিনামূল্যে শিক্ষা ব্যবস্থা (মূলত উচ্চ মাধ্যমিক এর পর ) চালু করা উচিত এবং মেয়েদের জন্যে স্পেশাল কর্ম-সংস্থান তৈরি করা উচিত। রাজ্য সরকার স্বল্প কিছু অর্থ প্রদান করে থাকে (রূপশ্রী ও কন্যাশ্রী প্রকল্প), এই পরিমাণটাকে আরো বেশি বাড়ানো উচিত। পণ নিষিদ্ধ আইন এর সমন্ধে আরো বেশি সচেতনতা ও তার বলবৎ খুবই প্রয়োজন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct