তাগিদ
সনাতন পাল
আষাঢ় মাস। সবে বর্ষার আগমন ঘটেছে। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে ঝিরঝিরি বৃষ্টি, মেঘের গুর গুর ডাক আর তার সাথে জুটেছে রস কদমের মত সাদা সাদা কদম ফুল । চারিদিকে কদম ফুলের গন্ধে ম-ম করছে। মাঠে অল্প জল জমেছে। পরানপুরের রহিম চাচার মাথায় একটাই চিন্তা, তাড়াতাড়ি ধানের বীজ ফেলতে হবে। শ্রাবণের প্রথম সপ্তাহেই খাঁপুরের মাঠের জমিতে ধান লাগানোর কাজ শুরু করতে হবে এবং দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে শেষ করতে হবে। এ দিকে হাতে একটা টাকাও নেই ওদিকে সময় মত ধান লাগাতে না পারলে ধানের ফলন ভালো হবে না,ধানের চেয়ে পাতানের পরিমাণ টাই বেশি হয়ে যাবে। তাঁর মাত্র তিন বিঘা চাষের জমি আছে। চাষ আবাদ ভালো না হলে ছেলে পুলে নিয়ে না খেয়ে একদম ঘরে পরে মরতে হবে। এমন কত ভাবনা যে রহিম চাচার মনে জাগছে, কে জানে ! অবশেষে সে গাঁয়ের মহাজন আমিনুর কে গিয়ে বলল, “ মুক হাজার পাঁচেক ট্যাকা হাওলাত দেওয়া পারমিন ? প্রত্যেক বছর হালার ধান লাগানার তঙ্কে মুর কাছে আর ট্যাকা থাকে না। চিন্তার কোনো কারণ নাই ভায়া, ধান উঠলেই সব হোদ দিয়্যা দিব গা। “ রহিম চাচার অতো জোর দিয়ে কথা বলা দেখে আমিনুর তাঁকে বলল, “ বন্যায় যদি ভব ধান নষ্ট হইয়া যায় , বা মাঝরা পোকার কারণে হব হ্যাস হইয়া যায় তখন মুক ট্যাকা কত থ্যাকা দিমেন ?” আমিনুরের কথা শুনে রহিম চাচা খানিকটা রাগান্বিত হয়েই বললেন, “ যদি এমন ডা হয়, তাহল্যা হালের বলদ জোড়া বেচতে হলেও বেইচ্যা হব ট্যাকা কড়ায় গন্ডায় হোধ কইরা দিমু।” সব শুনে আমিনুর, রহিম চাচাকে টাকা ধার দিতে রাজি হলেন কিন্তু কিছু শর্ত দিলেন। আমিনুরের কথা খুব পরিষ্কার,” এহন ধানের দাম পাঁচশো ট্যাকা মন, ধান যখন উঠবে তখন কাঁচা ধানের দাম হবো গিয়্যা সাড়ে তিনশো ট্যাকা মন । কিন্তু আমাগো ধান দিবা হবে আড়াই শো ট্যাকা মন। রাজি থাকলে কালক্যা আইস্যা টাকা নিয়া যাইও , না হলে এ হসবের মধ্যে আমি নাই।” সব কিছু শুনে এবং সব শর্ত মেনে শেষে টাকা নিতে রাজি হলেন। জমি চাষ করতেই প্রথমেই বাঁধা এলো, গরুর পায়ে লাঙলের ফাল ফুঁটল। অনেক রক্ত বের হলো কিছুটা জায়গা জুড়ে রক্তে জমির জল লাল হয়ে গেল। তারপরে পশু চিকিৎসককে বাড়ীতে ডেকে এনে দেখালেন। সেটাও আবার শো পাঁচেক টাকার ধাক্কা। মনে মনে রহিম চাচা ভাবল, “যে দেশে মানুষের চিহিসাই বিনা পয়সায় হয় না, সেহেনে আবার পশুর চিকিৎসা বিনা পয়সায় কি কইরা হবো !” ডাক্তার বাবু যাবার আগে বলে গেলেন, “ রহিম চাচা , গরুটারে দিন দশেক রেষ্ট দিও ।” উত্তরে সে বলল, “ সে তো দেওয়ান লাগবোই।” তারপরে এক বার চাষ করতে পাঁচ শো টাকা বিঘা চুক্তিতে সে ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ করিয়ে নিলেন। এর পরে ধান লাগানো হলো।
ঐ বছর আশ্বিন মাসের সপ্তাহ ধরে বৃষ্টিতে মরা আত্রেয়ী জেগে উঠল, তার উপরে আবার উত্তরের জল! মাঠের পর মাঠ বন্যায় ভেসে গেল। জল নেমে যাবার পরে যেটুকু অবশিষ্ট রইল সেগুলো আবার পরবর্তীতে ঝড়ো হাওয়ার কারণে ধান গাছের একদম কোমর ভেঙে মাটিতে শুয়ে পড়ল। ধান যখন মাড়াই করা হলো তখন দেখা গেল ধানের মধ্যে আর চাল নেই, বেশির ভাগই পাতান। এদিকে আবার কথা মত আমিনুরের টাকা শোধ করতে হবে তার বাবনা, ওদিকে খাবে কি তার চিন্তা- পকেটে একটা পয়সাও নেই। রহিম চাচার মেয়ে ফতেমা সামনের বার মাধ্যমিক দেবে। অনটনে সবার প্রথমে মেয়েটার পড়াশোনার উপরেই কোপ পড়ল! হালের বদল জোড়াও আমিনুরের ঋণ মেটাতে রহিমকে ছেড়ে চলে গেল। অবোলা প্রাণী কিন্তু যাবার সময় এমন ভাবে “ হাম্বা “ করে ডেকে উঠল, সে শুনে রহিমও আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না। গরু এবং মালিক দুজনেরই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল । ততক্ষণে পার্বতীপুরের বিমান দালাল দড়ি ধরে টানতে শুরু করেছে। চলে গেল রহিমের সাধের বলদ। সাধ করে নাম রেখেছিল রাই এবং কিশোরী। একসঙ্গে রাইকিশোরী বলেই ডাকত । কত কষ্টের দিন গেছে তবুও বেচে নি, কিন্তু এবারটা আর রক্ষা করা সম্ভবই হলো না। গরু যাবার পরে মাটি দিয়ে রহিম একটা একটা করে পায়ের দাগ গুলো মিশিয়ে দিল। এর মধ্যে ফতেমা এসে বলল, “ আচ্ছা আব্বু, গরীব মানুষের দুনিয়াতে জন্ম কেন হয়? আব্বু আস্তে করে বলল -”দুঃখকে উপলব্ধি করতে “। যাদের খাবার জোটে না, তাঁরাই বা দুনিয়াতে আসেন কেন?” রহিমের মুখে কোনো কথা নেই, স্থির নয়নে তাকিয়ে আছেন- মনে হচ্ছে কথা গুলো তিনি হয়তো শুনতেই পাচ্ছেন না। এর পরেই এলো রবি শস্য চাষের সময়। কিন্তু চাষ করবে কি করে ? হাতে একটা কানা কড়িও নাই। অবশেষে ধরণা দিলেন আরেক মহাজন,নারান গোঁসাইয়ের বাড়ীতে । যেখানেই যাচ্ছে টাকা ফেরতের শর্ত আর কেউ শিথিল করতে চাইছেন না। রহিম চাচা হন্যে হয়ে ঘুরছে আর ভাবছে, “ এহেনে কম সুদে ট্যাকা ধার দেওয়ার তঙ্কে এনা ব্যাঙ্ক থাকলে খুব ভালো হতো”। একবার খানিকটা বিরক্ত হয়ে নিজে নিজেই বলে উঠল, “ হালার দেশে মানুষ থাকে নাকি ! ধনী গো লোন দেওয়ার তঙ্কে ব্যাঙ্ক গুলা বইসা আছে, আর গরীব গো জন্য কিচ্ছু নাই- সব ফাঁক্কা !”
শেষে কোনো দিশা না পেয়ে ধারের টাকা দিয়ে আলু লাগালেন। সেই আলুতেও আবার ধসা রোগ! তারপরে যখন আলু উঠল, তখন আলুর দাম নাই! এ যে মরার উপরে খাঁড়ার ঘা। হাজার চেষ্টা করেও যেন বাঁচার জন্য আঁকড়ে ধরার কিছুই পাচ্ছে না। সবটাই যেন ফুটো নৌকা ধরে ভেসে থাকার মত দশা। আলুর ওঠার পরে খরচ বাদ দিয়ে সামন্য কিছু টিকেছে। কিন্তু অগ্রহায়ণ মাস অনেক দেরি সবে চৈত্র মাস। খানিকটা বাধ্য হয়েই আবার ছুটল সেই বোরো চাষের দিকে। বোরো ধানের ভরা খেতে সবুজ মাঠের দিকে তাকালে মন ভরে যায় কিন্তু লাভের ধন তো মহাজনেই নিয়ে যায়। বোরো ওঠার পরে আবার আমনের চাষ। এ ভাবে রহিম চাচা মাসের পর মাস গায়ের রক্ত জল করে একটার পর একটা জমি সবুজ করেই যায়। কিন্তু যখন সবুজ খেত সোনালি হয় তখনই মহাজনের আগমনীতে মনটা খারাপ হয়ে যায়। বছরে তিনটা ফসল হলেও সারের দাম, চাষের খরচ , বীজের দাম সব বাদ দিলে রহিমের মত লোকেরা সারা বছর জমিতে যে শ্রম দেয় তার মূল্যই পায় না। অভাবের সংসারে ফাতেমার বিয়ের বয়স হয়নি। কিন্তু সম্বন্ধ আসতেই অসহায় বাবা আর কোনো রকম রিস্ক না নিয়ে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলেন। পাশের বাড়ির হারান কাকার বাড়ীতেও একই হাল। একদিন হারান কাকা হাঁটে থেকে ফিরতেই খবর পেল- দু বছর আগে তাঁর ছোটো মেয়ে রুমাকে যে পনেরো বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে ছিলেন তাকে বাচ্চা হবার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। খবর পেয়েই বাবা ছুটে গেলেন মেয়ের কাছে। বাবাকে দেখে মেয়ে বলল, “ বাবা তুমি এসেছো ! কিন্তু অনেক দেরি করে এলে, বাবা।” বাবার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এসে মেয়ের গালের উপর টপ করে পড়ল। তার মিনিট পাঁচেকের পরেই মেয়ের কথা বন্ধ হয়ে গেল। স্বামী বিমান চিৎকার করে উঠল- “ সিস্টার........” । সিস্টার দৌড়ে এলো। দ্রুত ডাক্তার বাবুকে খবর দিলেন। ডাক্তার বাবু এসে হাত ধরেই বললেন-” সি ইজ নো মোর...”। পরে ডাক্তার বাবুর সাথে আলোচনা করে জানা গেল যে, অল্প বয়সে সন্তান সম্ভাবা না হলে হয়তো কিছু হত না। শুনে হারান কাকা মাথা ধরে বসে পড়লেন আর মুখে বললেন-” হা ভগবান, এ তুমি কি করলে..........।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct