গৌরকিশোর ঘোষ: জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধার্ঘ
প্রেম নেই
এ দেশের হিন্দু-মুসলমান সমস্যা যেন মরিয়া না মরে রাম । বারে বারে ধর্ম তাকে মাতায় , রাজনীতি তাকে তাতায়। এ সব সংঘর্ষে খেটে-খাওয়া হিন্দু বা মুসলমানের বিন্দুমাত্র লাভ নেই , বরং ষোলআনা ক্ষতি , তবু তারাই হয় দাবার ঘুঁটি। স্বাধীনতার পর কতকাল কেটে গেল, তবু সংঘর্ষের ধার ও ভার কমল না। সমাধানের কত চুক্তি , কত ফর্মুলা তৈরি হল , নেতারা গলদঘর্ম হলেন , কিন্তু সমস্যার শেকড়টাকে উপড়ে ফেলা হল না । তাই নব নব রূপে আবির্ভাব ঘটে সমস্যার। বহুকাল ধরে মুসলমানরা এ দেশে বসবাস করছে। প্রথম দিকে হিন্দু মুসলমানের সংঘর্ষ ছিল ব্যক্তিগত , কালক্রমে সেটা হয়ে দাঁড়াল সম্প্রদায়গত। তাই সংঘর্ষ ব্যাপকতায় ভীষণ হল। ইংরেজ রাজ্যাধিকারের পর দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যেতে থাকে। নবাবি আমলের অন্তিমপর্বে ব্যবসা-বাণিজ্য ও জমিদারিতে হিন্দুদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের মতো মুসলমানরা সেনাবাহিনী—রাজস্ব—প্রশাসনের কর্ম থেকে অপসারিত হয়। তার কারণ হিন্দুদের মতো পাশ্চাত্য শিক্ষাকে হাতিয়ার করে জীবিকার ক্ষেত্রে পাকা আসন লাভ করার চেষ্টা করে নি। রাজনৈতিক কারণেই ইংরেজ হিন্দু –মুসলমানের বিরোধ জিইয়ে রাখতে চেয়েছে। তারা মুসলমানদের বোঝাল দেশে প্রতিনিধিমূলক শাসন প্রচলিত হলে হিন্দুদের হাতে মুসলমানদের স্বার্থ বিঘ্নিত হবে। তাদের রক্ষা করতে পারে ইংরেজ। তাই হিন্দুদের মতো ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণ করা উচিত নয়। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মুসলমানদের অংশগ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়াল হিঁদুয়ানির আধিক্য। তাই ইলবার্ট বিল আন্দোলনে অংশগ্রহণ করল না মুসলমানরা। সৈয়দ আমির আলি বেঙ্গল ন্যাশনাল লিগ থেকে দূরে থাকলেন। কংগ্রেস থেকে মুসলমানদের দূরে রাখার জন্য তৈরি হল মহমেডান এডুকেশন কনফারেন্স । মুসলমানরা বিরোধিতা করল ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্টের।
হিন্দু মুসলমান সমস্যার শিকড়টা উপড়ে ফেলার পথ সম্ভবত রবীন্দ্রনাথই দেখিয়েছিলেন। ‘ইংরেজ ও ভারতবাসী’ , ‘সুবিচারের অধিকার’ প্রভৃতি প্রবন্ধে তিনি বলেছেন দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ইংরেজ বপন করেছে ঈর্ষের বীজ । কিন্তু শুধু ইংরেজকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। রবীন্দ্রনাথ ‘ব্যাধি ও তার প্রতিকার’ প্রবন্ধে বললেন, ‘ আজ আমরা সকলে এই বলিয়া আক্ষেপ করিতেছি যে ইংরেজ মুসলমানদিগকে গোপনে হিন্দুর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করিয়া দিতেছে । কথাটি যদি সত্যই হয় , তবে ইংরেজের বিরুদ্ধে রাগ করিব কেন। দেশের মধ্যে যতগুলি সুযোগ আছে , ইংরেজ তাহা নিজের দিকে টানিবে না, ইংরেজকে আমরা এত বড় নির্বোধ বলিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিব এমন কি কারণ ঘটিয়াছে । ’ইংরেজকে দোষ না দিয়ে রবীন্দ্রনাথ আত্মসমীক্ষার কথা বলেছিলেন। পূর্বোক্ত প্রবন্ধেই তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘হিন্দু মুসলমানের সম্বন্ধ লইয়া আমাদের দেশের একটি পাপ আছে, এ পাপ অনেকদিন হইতেই চলিয়া আসিতেছে। ইহার যে ফল তাহা না ভোগ করিয়া আমাদের কোনমতেই নিষ্কৃতি নাই। অভ্যস্ত পাপের সম্বন্ধে আমাদের চৈতন্য থাকে না, এইজন্য এই শয়তান যখন উগ্র মূর্তি ধরিয়া উঠে তখন সেটাকে মঙ্গল বলিয়াই জানিতে হইবে। হিন্দু মুসলমানের মাঝখানটাতে কত বড় কলুষ আছে এবার তাহা যদি এমন বীভৎস আকারে দেখা না দিত তবে ইহাকে আমরা স্বীকারই করিতাম না, ইহার পরিচয়ই পাইতাম না। ………..আর মিথ্যা কথা বলিবার কোন প্রয়োজন নাই। এবার আমাদিগকে স্বীকার করিতেই হইবে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে একটা বিরোধ আছে । আমরা যে কেবল স্বতন্ত্র তাহা নহে, আমরা বিরুদ্ধ।’ কেন বিরুদ্ধ? কারণ মুসলমানের সঙ্গে হিন্দুর ‘সহজ সামাজিকতার’ সম্পর্ক স্থাপিত হয় নি, ‘ আমরা বহু শত বৎসর পাশে পাশে থাকিয়া এক খেতের ফল , এক নদীর জল, এক সূর্যের আলো ভোগ করিয়া আসিয়াছি; আমরা এক ভাষায় কথা কই , আমরা সুখে-দুখে মানুষ; তবু প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ মনুষ্যোচিত, যাহা ধর্মবিহিত তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই।’
রবীন্দ্রনাথ যাকে সহজ সামাজিকতার সম্পর্ক বলেছেন, গৌরকিশোর ঘোষ তাকেই বলেছেন ‘প্রেম’। তাঁর ‘দেশ মাটি মানুষ’ ( হয়তো মমতা ব্যানার্জী এর থেকে প্রেরণা লাভ করে তাঁর দলের স্লোগান তৈরি করেছিলেন ‘মা মাটি মানুষ’ ) এই ট্রিলজিতে , বিশেষ করে দ্বিতীয় খণ্ড ‘প্রেম নেই’তে মুসলমান সমাজের সমস্যা ও হিন্দু- মুসলমান সম্পর্ক তুলে ধরেছেন শফিকুল ও বিলকিসের দাম্পত্য কাহিনি ও আনুষঙ্গিক ঘটনাধারার মধ্য দিয়ে। অতিরিক্ত ধর্ম ও দৈব নির্ভরতা , মোল্লা-মৌলবীদের উপর বিশ্বাস, ইংরেজি শিক্ষার প্রতি বীতরাগ –এ সব কারণে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলমানদের সংকট সৃষ্টি হয়। স্বল্প সংখ্যক যুবক যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানবোধের পরিচয় দিতেই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে মৌলবীরা। মৌলবীসাহেবের উক্তি : ‘ যে শিক্ষা মুসলমানের ছাওয়ালদের লা-মজহবী করে তোলে, মৌলবী মোল্লাদের উপহাস করতি শিখায়, সেই পাস-দেওয়াটা আমাগের কোন কাজে লাগবে ? ভাই মুসলমান আজ আমাদের বড় দুর্দিন। ইসলাম বিপন্ন। আমাগের ছাওয়ালদের আমরা বুকির রক্ত দিয়ে রোজগার করা টাকায় পাশ দিতি পাঠাচ্ছি আর তারা পাশ দিয়া আসে হিন্দুয়ানিতে রপ্ত হয়ে পড়ছে, আর তারা খোতবা পড়তি পারে না। ’ হিন্দু সমাজেও অনুরূপ ছবি দেখা যায়। ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের সময় রক্ষণশীল হিন্দুরা তাদের সন্তানদের আচরণ দেখে, শাস্ত্র ও আচারের প্রতি অভক্তি দেখে বিচলিত হয়ে পড়েছিল। হিন্দু –মুসলমানের সম্পর্ককে রাজনৈতিক কারণে বিষিয়েছিল ইংরেজ, জীবিকার ক্ষেত্রে হিন্দুদের থেকে পিছিয়ে পড়ে হীনমন্যতাবুধে আচ্ছন্ন হয়ে মুসলমানরা হিন্দুদের থেকে আরও দূরে সরে গেল । তখন সাধারণ মনুষ্যত্ব সরিয়ে তারা উভয়েই স্বতন্ত্র সম্প্রদায়ের পরিচয়ে গৌরব বোধ করতে লাগল । হিন্দুরা যেমন নিজেদের আর্যদের বংশধর মনে করে, তেমনি মুসলমানরা তাদের পৃথক অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে শুরু করে। জমিরুদ্দির উক্তি, ‘ মৌলবী দীন মোহাম্মদ দৌলতপুরী মুখির থে শুনিছি যে হিঁদুগের সঙ্গে মুছলমানদের মিশ খাওয়া সম্ভব না, ক্যান? না তার পেরধান কারণ এই যে ইরা দুটা আলাদা জাত। হিঁদুরা পয়দা হইছে হিন্দুস্থানে , মুসলমানরা পয়দা হইছে আরবে। আমাগের মুছলমানদের দেশ হল গে আরব দেশ। ’ তাই স্বদেশি আন্দোলন থেকে বাদ গিয়েছিল মুসলমানরা , তেমনি প্রজা আন্দোলন থেকে বাদ পড়ে হিন্দুরা। তবে কি হিন্দু মুসলমানে মিলনের ক্ষেত্র নেই? বিবেকবান, যুক্তিবাদী শফিকুলের এই প্রশ্নের উত্তরে মেজোবাবু যা বলেছিলেন, সেটাই গৌরকিশোরের বক্তব্য। মেজোবাবু বলেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই আছে। তবে তা আছে সমগ্র দেশের আঙিনায় ছড়িয়ে। দেশ থেকে অভাব, অস্বাস্থ্য, অশিক্ষা এবং নিরানন্দ দূর করার ব্যাপক কর্মসূচির মধ্যেই সহযোগিতার আহ্বান আছে। মিলনের ক্ষেত্র তৈরি হবে সেখানে, যেখানে কর্মের উদ্যোগ আছে। উপর থেকে রাজনীতির জাদুদণ্ড নেড়ে এ কাজ সমাধা করা যাবে না। ’আর সে কাজে নামতে হলে পরস্পরকে বুঝতে হবে, জানতে হবে, জীবনে জীবন যোগ করতে হবে।
বিশিষ্ট লেখক : দিলীপ মজুমদার
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct