মানব সভ্যতার বিকাশ এবং কল্যাণ সাধনে নদ-নদী বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। অতীত পর্যবেক্ষণ করলে আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারব যে পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলো নদীকে কেন্দ্র করেই বিকশিত হয়েছিল। মায়ের সঙ্গে তার সন্তানের সম্পর্ক যেমন অতি সুনিবিড় ঠিক তেমনি নদীর সাথে মানুষের। নদ নদীর জল কে মানুষ যেমন কৃষিকাজ, মৎস্য শিকার, শক্তি উৎপাদন, নদীকেন্দ্রিক পর্যটন, কৃষ্টি ও ধর্মীয় সংস্কৃতির মাধ্যম প্রভৃতি বহুবিধ কাজে এখন পর্যন্ত ব্যবহার করে আসছে, তেমনি তার উল্টো দিকে আমাদের মাধ্যমেই বিভিন্নভাবে নদীর জল দূষিত হয়ে চলেছে, কিছু ছোট নদীর অস্তিত্ব সংকট দেখা দিয়েছে, নদীতে অবস্থিত মৎস্য বৈচিত্র কমে যাচ্ছে, নদীর মাছের উপর নির্ভর করে প্রান্তিক মৎস্যজীবীদের অবস্থাও অনেকটাই আজকে শোচনীয়, অনেক নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ার ফলে সামান্য এবং একনাগাড়ে বেশি বৃষ্টির ফলে নদীর জল উপচে পড়ে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের অভিন্ন অন্তপ্রাণ উত্তরবঙ্গ। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় অসংখ্য ছোট-বড় নিত্যবহ এবং অনিত্যবহ নদী যেমন রয়েছে তেমনি এখানকার পাহাড়, ঝরনা, ঝোরা, অরণ্যের নয়নাভিরাম অপার সৌন্দর্য এই সুদীর্ঘ অঞ্চলকে দেশ তথা বিশ্ববাসীর কাছে আলাদা একটা পরিচিতি হিসেবে তুলে ধরেছে। আত্রেয়ী,পুনর্ভবা,টাঙ্গন,কুলিক থেকে মহানন্দা, জলঢাকা, তিস্তা, তোর্সা, সং কোষ, কলজানি,রায় ডাক প্রভৃতি নানান রকমের ছোট-বড় নদী উত্তরবঙ্গের প্রাণশক্তিকে সর্বদা প্রাণ প্রাচুর্যে ভরিয়ে তুলেছে। উত্তরবঙ্গের আটটি জেলা মিলিয়ে কমবেশি সর্বমোট 200 টিরও বেশি নদী রয়েছে। বর্ষাকাল এলেই উত্তরবঙ্গের নদী গুলো ফুলে ফেঁপে ওঠে। অনেকে নদী যৌবনবতী বলে থাকেন।আদতে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর দাপটে যখন সমগ্র বিশ্ব ওষ্ঠাগত, তখন বর্ষাকালে গৌড় ভূমি বা ডুয়ার্সের নদীগুলোর চেহারা দেখলে ধারণাটাই বদলে যেতে পারে। অতিরিক্ত জলস্ফীতি র কারণে নদীকেন্দ্রিক এলাকায় ধসের দৃশ্য প্রায়ই চোখে পড়ে থাকে । অন্যদিকে নদীর তলদেশে দীর্ঘদিন পলি জমে নাব্যতা কমে যাওয়ার দরুন কয়েক বছর অন্তর অন্তর বন্যার চিত্র বর্তমানে প্রায় প্রচলিত হয়ে গেছে। কিছু ক্ষেত্রে বন্যার ভয়াবহতার প্রতীক হিসেবে সালগুলোর বিভীষিকা মানুষের মনে এখনো নাড়া দেয়। তবে আর যাই হোক, বন্যা মোকাবেলায় সরকারি, প্রশাসনিক, জনসাধারণ কত আগাম প্রস্তুতির পাশাপাশি সুষ্ঠু বন্যা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনার বাস্তব প্রয়োগ প্রয়োজন। নদীর পাড় ভাঙ্গন রুখতে বিশেষ প্রজাতির ঘাস লাগানো, বৃক্ষরোপণ ইত্যাদি কর্মসূচি ছাড়াও নদী খাত ড্রেজিং এবং নদী খাত পুনঃ ক্ষণন বা re excavation এরও বিশেষ প্রয়োজন। বন্যা প্রতিরোধ কারী বিভিন্ন নদীতে অবস্থিত বাঁধ গুলোর অবস্থা ও স্লুইস গেট গুলো বর্ষাকাল আসার আগেই নিয়মিত নিরীক্ষণ প্রয়োজন। নদীর পাড় বাঁধ বা embankment ঠিকমতো দেওয়া রয়েছে কিনা, দুদিকে পাড় বাঁধ নির্মাণের নেতি বাচক দিকগুলো বিবেচনা করা প্রয়োজনীয়। অতিবৃষ্টি পরবর্তী অতিরিক্ত জল কে দ্রুত সরিয়ে দেবার জন্য নিকাশি ব্যবস্থা বা drainage system কতটা কার্যকরী রয়েছে,সেটা দেখে নেওয়া প্রয়োজন। Flood shelter বা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র গুলো কি অবস্থায় রয়েছে,সেগুলোও প্রাক বর্ষাকালীন সময়ে পরিদর্শনের প্রয়োজন রয়েছে। উত্তরবঙ্গের যেসব নদীগুলোতে বাঁধ এবং স্লুইস গেট রয়েছে সেখানে বর্ষাকালে অতিরিক্ত জলকে ছাড়ার পূর্বে সংশ্লিষ্ট এলাকায় তার কিরূপ প্রভাব পড়তে পারে সেটির পূর্ব সমীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। উত্তরবঙ্গের বন্যা প্রসঙ্গে মালদা মহা বিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের নবীন অধ্যাপক মিঠুন রায় বলেন “ উত্তরবঙ্গে বন্যা প্রবণতা বৃদ্ধি পাবার অন্যতম কারণ হলো পরিবহন ব্যবস্থা। কারণ এখানকার প্রায় সব নদী গুলোই উত্তর থেকে দক্ষিনে প্রবাহিত হয়েছে, অপরদিকে বিভিন্ন সড়ক পথ, রেলপথ, পূর্ব থেকে পশ্চিমে নির্মিত । ফলে এই সড়ক পথ, রেলপথ নির্মাণ করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার নদীর গুলোর প্রবাহ অনেকটাই সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছে। উদারণসরুপ জলপাইগুড়ি থেকে ময়নাগুড়ি যাওয়ার পথে তিস্তা ব্রীজ সংলগ্ন তিস্তা নদীর চিত্র পর্যবেক্ষণ করলেই অনেকটা ধারণা পরিস্ফুট হবে। তিস্তা ব্রিজের 2 কিমি আগে ও 2 কিমি পরে অব্দি নদীটি যথেষ্টই স্ফীত ও চওড়া, কিন্তু তিস্তা ব্রীজ সংলগ্ন এলাকায় এটি অনেকটা সংকীর্ণ। যার ফলে পাড় ভাঙ্গন সেখানকার স্থানীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া তিস্তা ব্যারেজের সঙ্গে সংযুক্ত ফিডার ক্যানেল ও কৃষি ক্যানেলে অনিয়মিত এবং ভারসাম্যহীন জলপ্রবাহ তিস্তা বেসিনে বন্যার অন্যতম কারণ।এছাড়া প্রায় সব জায়গায় নিকাশী ব্যবস্থা অনুন্নত হবার ফলে বিষয়টি শুধুমাত্র নদীর আঙ্গিকে ভাবলে চলবে না। পাশাপাশি আলিপুরদুয়ারের অধিকাংশ নদীগুলোতে বিশেষত জয়ন্তী নদীতে ডলোমাইট উত্তোলনের দরুন তার ধূলিকণা বা sediment জল স্রোতের সাথে মিশে নদীগুলোর নাব্যতা হ্রাস করছে, যার ফলে সেখানে প্রায়ই flush flood দেখা যায়।” মোদ্দাকথা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের অন্তর্গত বন্যা এবং তৎসহ বন্যা ব্যবস্থাপনা বিষয়টিকে আরো গভীরে ভাববার প্রয়োজন রয়েছে।নচেৎ প্রায় ফি বছর আমরা বন্যার আতঙ্ক থেকে দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারবো না।
সজল মজুমদার, শিক্ষক ও বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct