আফগানদের দুঃখের গান শেষ হয় না। যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, বিদেশি শক্তির আগ্রাসনে ক্ষতবিক্ষত এ মালভূমি। যেমন তার রুক্ষ পর্বত ও শুষ্ক আবহাওয়া, তেমন তার ভাগ্য। মরুভূমি যেমন মুহূর্তেই শুষে নেয় একপশলা বৃষ্টির ফোঁটা, তেমন আফগানদের জীবন থেকে কে যেন শুষে নিয়েছে যাবতীয় আনন্দ ও উচ্ছলতা। বারবার হানা দেয় হানাদার বাহিনী। দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে সেই হানাদার বাহিনীও দূর হয়। নতুন সরকার আসে, তবু মাথা তুলে দাঁড়ানো হয় না। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে লিখেছেন রাফসান গালিব। আজ প্রথম কিস্তি।
আফগানদের দুঃখের গান শেষ হয় না। যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, বিদেশি শক্তির আগ্রাসনে ক্ষতবিক্ষত এ মালভূমি। যেমন তার রুক্ষ পর্বত ও শুষ্ক আবহাওয়া, তেমন তার ভাগ্য। মরুভূমি যেমন মুহূর্তেই শুষে নেয় একপশলা বৃষ্টির ফোঁটা, তেমন আফগানদের জীবন থেকে কে যেন শুষে নিয়েছে যাবতীয় আনন্দ ও উচ্ছলতা। তাদের স্বাধীনতা, স্বকীয়তা, সংস্কৃতি বারবার তছনছ হয়ে যায়। হাতছাড়া হয়ে যায় প্রাকৃতিক সম্পদ। বারবার হানা দেয় হানাদার বাহিনী। দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে সেই হানাদার বাহিনীও দূর হয়। নতুন সরকার আসে, তবু মাথা তুলে দাঁড়ানো হয় না। ঘর গোছানোর আগে আরেক দুর্যোগ এসে সেটি ভেঙে দিয়ে যায়।গত দুই দশকে কতবার যে ‘মানবিক বিপর্যয়’ শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে আফগানিস্তানকে নিয়ে, সেটির শেষ আর হয় না। বুধবার ভোরে ভয়াবহ ভূমিকম্প এসে সেই বিপর্যয় যেন আরও বাড়িয়ে দিল। পূর্বাঞ্চলীয় পাকতিকা ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় খোস্ত প্রদেশে সেই ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত সহস্রাধিক মানুষ মারা গেছে। ভূমিকম্পের কয়েক দিন পর্যন্ত ধ্বংসস্তূপের নিচে বিপুল মানুষ চাপা পড়ে থাকার খবর আমরা পাই বিদেশি বার্তা সংস্থা থেকে। একে তো দরিদ্র পাহাড়ি এলাকা। বাড়িঘরগুলোও দুর্বল। ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি সয়ে টিকে থাকার মতো নয়। ফলে ভূমিকম্পের ধাক্কায় শত শত বাড়িঘর ধসে পড়েছে। অনেক গ্রাম একেবারে গুঁড়িয়ে গেছে।
এক ভূমিকম্প আরও ভূমিকম্পকে টেনে নিয়ে এসেছে, পরপর কয়েকবার ভূকম্পনে কাঁপে ওই এলাকা। ডেকে নিয়ে এসেছে আরও দুর্যোগ—টানা ভারী বৃষ্টি, তুষারপাত, শিলাবৃষ্টি, ভূমিধস ও বন্যা। মড়ার উপর একের পর এক খাঁড়ার ঘা। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া মানুষকে উদ্ধার করার পরিস্থিতিও সেখানে রইল না। কী এক অবর্ণনীয় পরিস্থিতি সেখানে তৈরি হয়েছে, তার কতটা প্রতিফলন আমরা দেখছি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে? করোনা পরিস্থিতিতে টালমাটাল গোটা বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেল আফগানিস্তানে দীর্ঘ যুদ্ধের অবসানের ঘটনা। সশস্ত্র গোষ্ঠী তালেবানের হাতে পরাজয় বরণ করে পরাশক্তি আমেরিকা ও তার মিত্রদের লজ্জাজনক প্রত্যাবর্তন ঘটল। ক্ষমতার পালাবদলে কাবুলের মসনদে বসল তালেবান। আফগানিস্তান কার কার বাণিজ্যের বাজার হতে যাচ্ছে, তার প্রাকৃতিক সম্পদের ফায়দা লুটতে যাচ্ছে কে—চীন নাকি রাশিয়া? তালেবান সরকারের ওপর কতটা প্রভাব বিস্তার করতে যাচ্ছে তুরস্ক বা কাতার? আফগানিস্তান থেকে ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসা ভারত কীভাবে আবার তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে? তালেবানের কাবুল দখলে পাকিস্তানের বিজয় ভূরাজনীতিকে কীভাবে পাল্টে দিচ্ছে?
এমন সব বিষয় নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে দুনিয়ার সব বাঘা বাঘা রাজনৈতিক বিশ্লেষক, অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিবিদ ব্যস্ত ছিলেন কয়েক মাস। আফগানিস্তানে যুদ্ধ শেষ হলেও প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সাজসাজ যুদ্ধ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কী তুমুল উত্তেজনা, তর্কবিতর্কের শেষ নেই। কিন্তু দিন শেষে দেখা গেল কী, আফগানিস্তানের পাশে কেউ নেই, কাবুলের নতুন সরকার তালেবানকে কেউ স্বীকৃতি দেয় না। আফগানিস্তানে বিশ্ববাজারের পা পড়ে না। অর্থনীতিও চাঙা হয় না। তালেবানের বিজয়ের অংশীদার পাকিস্তানও এক পা এগিয়ে আসে তো আরেক পা পিছিয়ে যায়। টানা দুই দশক ধরে যুদ্ধ করে ক্ষমতায় আসা দলটিও কঠোর কঠোর নিয়মে নাগরিকদের জন্য জীবনকে করে তোলে আরও বেশি কঠিন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের চেয়েও, প্রায় দুর্ভিক্ষে ভুগতে থাকা মানুষের পেটে খাবার দেওয়ার চেয়েও তালেবান সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে মেয়েরা স্কুলে পড়বে কি পড়বে না, বোরকার সীমারেখা কতটুকু হবে, পুরুষেরা চুল-দাড়ি কেমন রাখতে পারবে, উপস্থাপিকারা কীভাবে টিভি পর্দায় হাজির হবেন এসব বিষয়। সেসবের কারণে পশ্চিমা গোষ্ঠীও দেশ পুনর্গঠনে নানা শর্তের বেড়াজালে জড়িয়ে ফেলে তালেবান সরকারকে। অনেক সাহায্য ও সহায়তাকারী সংস্থাও তো তালেবান ক্ষমতায় আসার পরপরই নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। অবশেষে জাতিসংঘের মাধ্যমে আমরা দেখছি কী, খাদ্যসংকটে আফগানিস্তানে ৯৩ শতাংশ মানুষ। দেশটির অর্থনৈতিক সংকট এতটাই ভয়াবহ যে তারা টেবিলে খাবার সরবরাহ করতেও পারছে না।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct