সম্প্রতি ভারতে মুদ্রাস্ফীতি দ্রুত ভাবে ঊর্ধ্বগতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি এবং সাধারণ আমজনতাকে খুবই সমস্যার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী করোনার প্রভাবের আগেই কার্যত ভারতীয় অর্থনীতি খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে ছিল। গত ৪৮ বছরের মধ্যে সর্বাধিক বেকারত্বের হার উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে দেশের মধ্যে উদ্বেগ প্রতিফলিত হয়েছে। কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে ভারতীয় কোষাগারে ভয়ঙ্কর চাপ পড়ল। এ বিষয়ে লিখেছেন আমির আলি। আজ দ্বিতীয় কিস্তি।
প্রবাসী অর্থনীতিবিদদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে এসে আলোচনা-পর্যালোচনা মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতির প্রতি যথাযত ব্যবস্থা না গ্রহণ করলে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর আকার ধারন করতে পারে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। মূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে চিরাচরিত হাতিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ নীতি। অষ্টাদশ দশক থেকেই বিশ্বের আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের নির্দেশিত পথেই চলেছে বিশ্বের অধিকাংশ অর্থনীতি। আই এম এফ সবসময়ই সরকারগুলোকে খরচ কমানোর জন্য চাপ দেয় এবং কোষাগার ঘাটতি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখতে বলা হয়। কোষাগার ঘাটতির পাল্টা হিসেবে কাজ করে শিথিল ঋণ নীতি। আমেরিকাসহ উন্নত দেশ সমূহ ব্যাংক ঋণের সুদ শূন্য করে দিয়েছিল। ফলে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে বাস্তব অর্থনীতির অগ্ৰগতি ঘটুক না ঘটুক বিদেশি লগ্নিকারীদের প্রচুর অর্থ শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ হয়। বিদেশি লগ্নিকারীদের বিনিয়োগ দেখে দেশের সাধারণ লগ্নীকারিরা উৎসাহিত হয়ে তারাও লগ্নি দিকে ঝুঁকে পড়ে। কোভিদ হঠাৎ করে এই পরিস্থিতিতিটা মারাত্মকভাবে পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে উন্নত দেশগুলি সুদের হার বাড়িয়ে দেয় ফলে লগ্নি যোগ্য মূলধনের দাম বৃদ্ধি পায়। বিদেশি আর্থিক সমস্যা গুলি উন্নয়নশীল দেশগুলির শেয়ার বাজার থেকে লগ্নি তুলতে শুরু করে দেয় ফলে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের উপর বেশ কিছুটা চাপ পড়ে। উন্নত দেশের বাজারে সস্তা নগদ অর্থের যোগান সীমিত হওয়ায় ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে গভীর সংকটে পড়ে যায়। বিদেশি লগ্নি উঠে যাওয়ায় ভারতের ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি দেখা দেয়, তখনই ভারতীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটে এবং আমদানি খরচ বৃদ্ধিতে মুদ্রা সংকটে গভীর ঋণের জালে ভারত জড়িয়ে পড়েছে।
রিজার্ভ ব্যাংক মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধির পূর্বাভাসে আমজনতার উদ্বেগ প্রকাশ আরও বাড়িয়ে দিল। মূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আশানুরূপ ফল মিলছে না দেখে, গত মাসেই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া রেপো রেট বাড়িয়ে দেয়। বর্তমান আর্থিক বছরে ৮ই জুন ক্যাশ রিজার্ভ অনুপাত ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়। একইদিনে জোড়া সূচক বৃদ্ধি হলে ব্যাঙ্কগুলি ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সংযত হয় ফলে কিছুটা হলেও বাজারে নগদের যোগান নিয়ন্ত্রণ হয়। ব্যাংকে রিজার্ভ ব্যাংকের নগদের যোগান কমলে বা সহজে ঋণ না পেলে সাধারণ মানুষ বিলাসবহুল পণ্যের কেনাবেচা কমিয়ে দেবে শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে অর্থ ব্যয় করবে। রিভার্স রেপো কমে দাঁড়ায় ৩.৩৫% বাজারের মূল্য বৃদ্ধির নিয়ন্ত্রণ সহায়ক হবে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভারতের ক্রোমাবস্থান খারাপ থেকে প্রায় খারাপতম পর্যায়ে নেমে গেছে এটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ ভবিষ্যতে ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে (জিডিপি) চলতি আর্থিক বর্ষে একইরকম থাকবে বরং কমার আশঙ্কা রয়েছে। পৃথিবীর বেশিরভাগ বড় দেশের অর্থনীতির মতই প্রাক্তন গভর্নর রঙ্গরাজন মনে করেন আর্থিক ঘাটতি মুদ্রীকরণ ছাড়া আর কোন উপায় নেই।সম্প্রতি তিনি বলেন ঘাটতি পূরণে মূদ্রীণিকরণ অবশ্যই জরুরী। ব্যয়বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে হলে সরকারের ঋণ মুদ্রীকরণ ছাড়া গতি নেই। প্রশ্ন থাকতে পারে ভারত সরকার রিজার্ভ ব্যাংকের নতুন নোট ছাপাতে বলছে না কেন, কারণ মুদ্রীকরণ একটি বহু বিতর্কিত বিষয়। সম্প্রতি এই পদক্ষেপে বিরোধিতা করেন আরও একজন প্রাক্তন গভর্নর ডি. সুব্বারাও। এই সংকটের সঙ্গে মোকাবিলা করতে ভারতকে আরও বেশি ঋণ এবং ব্যয় করতে হবে যা প্রশ্নাতিত। সরকারি আর্থিক ঘাটতিতে সরাসরি অনেক সমস্যা আছে তার প্রধান যুক্তি শুরুটা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, শেষটা নিয়েই সমস্যা। আদর্শ পরিস্থিতিতে এই হাতিয়ার ব্যবহার করে বেসরকারি চাহিদা কমতে থাকলে সার্বিকভাবে চাহিদা পরে বাড়াতে পারে, তবে ঠিক সময়ে এই রাস্তা থেকে সরে না এলে অন্যরকম আর্থিক সংকটের বীজ বপনের সম্ভাবনা থেকে যেতে পারে। ২০ শে মার্চে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৬.৯৫%।
লেখক বর্ধমান ইউনিভার্সিটি অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct