অগ্নিবীর প্রকল্প বিহারে ‘অগ্নি’পথে রূপ নেওয়ার কারণ (আশা এবং হতাশা)
ফৈয়াজ আহমেদ
মোদী সরকারের নতুন ‘অগ্নিপথ’ (সশস্ত্র বাহিনী নিয়োগ) প্রকল্পের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কেন বিহারে সবচেয়ে বেশি, তা জানতে হলে পটনার ঐতিহাসিক গান্ধী ময়দানে একবার প্রাতঃভ্রমণে ঘুরে আসাটা শিক্ষণীয় হতে পারে। ১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে “জেপি আন্দোলন” এর জন্মস্থান, যেখানে শ্রদ্ধেয় জয়প্রকাশ নারায়ণ ইন্দিরা গান্ধীর কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র ও যুবকদের একটি শক্তিশালী সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই বিস্তৃত ক্ষেত্রটি আজকের ‘যুব ভারত, সম্পর্কে দুটি বিপরীত সত্যকে দৃশ্যমানভাবে চিত্রিত করে - আশা এবং হতাশা। আশা হল ভারতের বিপুল অতুলনীয় তরুণ জনসংখ্যা এবং এটি যে বিশাল সৃজনশীল সম্ভাবনার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে তা উপলব্ধি হয়। প্রতিদিন সকালে, এই গান্ধী ময়দানটি শত শত তরুণ ছেলে-মেয়েদের কঠোর শারীরিক প্রশিক্ষণ – শারীরিক কসরত, ডনবৈঠক, দৌড়াদৌড়ি ইত্যাদি অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকদের নির্দেশনায় খুবই শৃঙ্খলার সঙ্গে চলছে। এই প্রশিক্ষকরা কয়েক ডজন প্রশিক্ষণ পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান দ্বারা নিযুক্ত করা হয় যা ভারতের সশস্ত্র বাহিনীতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবকদের চাকরির প্রতিশ্রুতি দেয়। সেই আশায় জল ঢেলে দিয়েছে বর্তমান ‘অগ্নিবীর’ প্রকল্প। সেই আশারও অবলুপ্তি ঘটানো হল বিএসএফ, সিআরপিএফ, রেলওয়ে পুলিশ এবং রাজ্য পুলিশে ভর্তির। শুধু তাই নয় বিহারবাসী যুবকদের সরকারী চাকরির জন্য তীব্র অনুসন্ধানের আরও একটি বড় কারণ আছে। বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাব। আইএএস, অন্যান্য কেন্দ্রীয় সরকারী এবং রাজ্য সরকারী চাকরীর জন্য পরীক্ষা সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক এবং প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হাজার হাজার তরুণ প্রার্থীদের জন্য প্রচুর কোচিং সেন্টারের রমরমা। যার ফলে রাজ্যের অনেক রেল স্টেশনকেও দ্বিগুণ বহরে বাড়াতে হয়েছে। আমরা দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে অনুরূপ দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি না কারণ এই রাজ্যগুলির অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে আরও সমৃদ্ধ এবং সশস্ত্র বাহিনী এবং সরকারী বিভাগের বাইরে কমপক্ষে কিছু কর্মসংস্থানের সুযোগ সেখানে আছে। আদর্শগতভাবে, এত বিশাল তরুণ জনসংখ্যা ভারতের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য আশার উৎস হওয়া উচিত। যাইহোক, হতাশার এই দৃঢ় বাস্তবতা থেকে স্পষ্ট যে বেশিরভাগ যুবক-যুবতীরা তারা যে চাকরিগুলি আশা করে এবং প্রশিক্ষণ নিচ্ছে তা পাবে না। চাহিদা এত বেশি এবং সুযোগ খুব কম। এটি ব্যাখ্যা করে যে কেন বিহার এবং উত্তর ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্য অগ্নিপথ প্রকল্পের বিরুদ্ধে সহিংস বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। এই ক্ষোভের একটা অংশকে দায়ী করা যেতে পারে যে, গত দু বছর ধরে ভারতীয় সেনাবাহিনী নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে বিক্ষোভকারীদের ক্রোধের জন্য একটি বড় কারণ এই নতুন পরিকল্পনার মধ্যেই নিহিত রয়েছে।
প্রথমত: সশস্ত্র বাহিনী মোট নিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি করেনি। ১৭-২১ বছর বয়সী মাত্র ৪৫,০০০ তরুণ-তরুণীকে নিয়োগ দেওয়া হবে, যেখানে লক্ষ লক্ষ প্রার্থী রয়েছেন। অবশ্যই, সশস্ত্র বাহিনী একটি আয়ের উত্তম মাধ্যম হিসাবে আশা করা যায় না। কিন্তু যখন সরকার একটি অভিনব নতুন নাম সহ একটি অভিনব নতুন প্রকল্প নিয়ে আসে - যেটি প্রধানমন্ত্রী মোদীর বরাবর একটি ঝোঁক রয়েছে। সেই অভিনবত্বের সাথে বেকার যুবকদের প্রত্যাশাকে আরোও বাড়িয়ে তোলে, বিশেষ করে দরিদ্র ও গ্রামীণ পটভূমি থেকে। সুতরাং, বিশুদ্ধভাবে পরিমাণগত ভাবে, অগ্নিপথ তাদের উচ্চতর প্রত্যাশাকে জাগিয়ে তোলে।
দ্বিতীয়ত: সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীতে সৈনিক হতে ইচ্ছুক তরুণদের যে বিষয়টি আরও বেশি করে হতাশ করেছে, তা হলো, যাদের নিয়োগ করা হবে, তাদের মধ্যে মাত্র ২৫ শতাংশ প্রকৃতপক্ষে সশস্ত্র বাহিনীতে কাজ চালিয়ে যাবে। বাকি ৭৫ শতাংশ নিয়োগপ্রাপ্তরা চার বছর চাকরি করার পর কোনও পদ ছাড়াই এবং কোনও পেনশন ছাড়াই অবসর নেবেন। সুতরাং, বিক্ষোভকারীরা যে প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করছে তা সত্যর সমার্থক: “সরকার কেন নিয়োগপ্রাপ্তদের জন্য একটি সুন্দর শব্দযুক্ত নাম ‘অগ্নিবীর’ দিচ্ছে, যদিও তাদের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ মাত্র চার বছর পরে বেকার হতে চলেছে?”
তৃতীয়ত: যদিও এই প্রকল্প প্রনয়ণকারীদেরও কিছু বক্তব্য আছে। তা হল এই যুবকরা চাকরী করা কালীন তাদের শিক্ষা চালিয়ে যেতে পারবেন। চাকরী শেষে থোক টাকা পাবেন এবং মাহিনাবাবদ প্রাপ্ত প্রায় দশ লক্ষ টাকা পাবেন। কিন্তু তাঁরা এক চরম সত্যকে উপেক্ষা করে যাচ্ছেন সেটা হল, ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীতে কাজ করার যে সামাজিক সম্মান ‘ফৌজি’ হিসাবে গ্রামীন ভারতে এখনও মেলে তা তাদের থেকে চলে যাবে। প্রকৃত পক্ষে যারা সৈনিক হতে আসে তাদের মধ্যে অনেকেই কৃষক সম্প্রদায় থেকে আসে। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাক যুদ্ধের সময় ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী কর্তৃক জনপ্রিয় ‘জয় জওয়ান জয় কিষাণ’ স্লোগানটি এখনও গ্রামীন ভারতে দেশপ্রেমের একটি দৃঢ় অনুভূতি জাগায়। অতএব, নিয়োগ পাওয়ার পরে ‘অগ্নিবীর’ হওয়া এবং তারপরে চার বছর পরে নিজেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়া, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জন্য ব্যক্তিগত বা জাতীয় গর্বের উৎস মোটেও নয়। এটা নিঃসন্দেহে হতাশার একটি উৎস। তাছাড়া, যারা সেই ৭৫ শতাংশের অন্তর্ভুক্ত হবে। তাদের পরিবার, সম্প্রদায়কে সামাজিকভাবে অনেক নিচে নামিয়ে আনবে। আজও গ্রামীন ভারেত যখনই কোনও ব্যক্তি ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নির্বাচিত হন, তখন পুরো গ্রামটি আনন্দিত হয় এবং গ্রামের গর্ব ও মর্যাদাকে বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য জওয়ানকে অভিনন্দিত করার জন্য পুরো গ্রামে হোর্ডিং লাগানো হয়। তাহলে অগ্নিবীরদের সেই অনুভূতি দুর্দশা এবং অপমানের দৃশ্য গুলো কল্পনা করুন, যারা তাদের গ্রামের সম্প্রদায়ের দ্বারা এত প্রশংসিত হবে এবং যারা চার বছর পরে সশস্ত্র বাহিনী থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে আসবে।
চতুর্থত: ভারতে বেকারত্বের সমস্যার সঙ্গে আরও একটি গভীর ভাবে উদ্বেগজনক ঘটনা জড়িত। সেটা হল বর্তমানে বহু রাজ্য সরকার বহু ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি ‘চুক্তি’ ভিত্তিক চাকরী বহাল করেছে। কিন্তু ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর চাকরীর সঙ্গে এটি গুলিয়ে ফেললে হবে না। অগ্নিবীররাও যদি এই ধরনের স্বল্পমেয়াদী চুক্তিভিত্তিক কর্মসংস্থানের শিকার হন, তবে দুটি পরিণতি হবে: ৭৫ শতাংশ ব্যর্থ অগ্নিবীররা সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি আজীবন প্রতিশ্রুতি বা বিশেষ শ্রদ্ধা বা যে কৃতজ্ঞতা ছিল সেটি ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে। আরও উদ্বেগের বিষয় হল, দরিদ্র ও গ্রামীণ সম্প্রদায়ের মনোভাব। যেখানে এই গ্রামীন ভারতের যুব সম্প্রদায় যদি এই ‘অগ্নিবীর’কে বেকারত্ব মোচনের পন্থা হিসেবে নেয়। তখন দেশ ভক্তি বা দেশ সেবা কোথাও কি একটু ম্লান হয়ে যাবে না। প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। যে কোনও বিক্ষোভে সহিংসতা অবাঞ্ছিত এবং অবশ্যই এর নিন্দা করা উচিত। তা সত্ত্বেও, নতুন প্রকল্পের উদ্দেশ্যগুলি নিয়ে জন মানসে পরিস্কারভাবে জ্ঞাত করাতে মোদী সরকারের চরম ব্যর্থতাকে উপেক্ষা করা যায় না। যা বর্তমান সরকারের বিলম্বিত বোধদ্বয় হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। তা যদি আগে করার চেষ্টা করা হতো হয়ত এই সহিংসতা এড়ানো যেত। সরকার যদি রাজ্য সরকার, সশস্ত্র বাহিনীর প্রবীণ বা অবসরপ্রাপ্ত, যুব গোষ্ঠীর (যেমন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান) সাথে আগে থেকে আলোচনা করত এবং সম্ভবত ধীরে ধীরে এটি বাস্তবায়ন করত, তবে সমাজ এটি গ্রহণ করার জন্য আরও ভালভাবে প্রস্তুত হত। দুর্ভাগ্যবশত, অতিতেও দেখা গেছে, সুবিধাগ্রহিতাদের সাথে পরামর্শ এমন একটি বিষয় যা বিজেপি সরকার কখনও বিশ্বাস করে না। গত বছর তিনটি অগণতান্ত্রিকভাবে প্রণীত কৃষি আইনের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী কৃষক আন্দোলনের সময় দেশটি আন্দোলনকারীদের প্রতি সরকারের এই অবজ্ঞা দেখেছিল। পরে প্রধানমন্ত্রী সেই আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। অগ্নিপথ প্রকল্পের ক্ষেত্রেও তিনি একই কাজ করতে বাধ্য হতে পারেন, অথবা আন্দোলনরত যুবকদের সন্তুষ্ট করার জন্য কমপক্ষে এর কিছু বৈশিষ্ট্য সংশোধন করতে পারেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct