কার পারমাণবিক সামর্থ্য কতটুকু, তার চেয়েও অংশীজনদের ইচ্ছার ওপর সেটা নির্ভর করে। পরমাণু যুদ্ধের উত্তেজনা থেকে পশ্চিমারা নিজেদের সরিয়ে নিতে পারে, কিন্তু সেটা হতে হবে সুনির্দিষ্ট বিষয়ের ভিত্তিতে। পুতিনের পরমাণু অস্ত্রের হুমকির কারণে পশ্চিমা সরকারগুলো ইউক্রেনে সেনা পাঠাতে বিরত রয়েছে। তবে এ সিদ্ধান্ত পারমাণবিক সামর্থ্যে রাশিয়ার আধিপত্য রয়েছে, এমনটা নির্দেশ করে না। কিন্তু পশ্চিমের কাছে ইউক্রেন গুরুত্বপূর্ণ হলেও প্রধান স্বার্থ নয়। এ নিয়ে লিখেছেন জোসেফ এস নাই। আজ শেষ কিস্তি।
পঞ্চম, তথ্যযুদ্ধ যুদ্ধের ক্ষেত্রে একটা পার্থক্য তৈরি করে দেয়। দুই দশক আগে র্যান্ড করপোরেশনের (অলাভজনক নীতিনির্ধারণী সংস্থা) জন আরকুইলা বলেছিলেন, আধুনিক যুদ্ধের জয়-পরাজয় শুধু সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করে না, ‘কার গল্পটা জিতছে’ তার ওপরও নির্ভর করে। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সামরিক পরিকল্পনার গোয়েন্দা তথ্য খুব সতর্কতার সঙ্গে প্রকাশ করে দেয়। এর ফলে ইউরোপের কাছে পুতিনের পক্ষের বয়ান আর বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। আগ্রাসনের শুরুতেই ইউক্রেনের জন্য পশ্চিমে ব্যাপক সংহতি তৈরি হয়। ষষ্ঠ, সামরিক ও মনস্তাত্ত্বিক দুই ধরনের শক্তিই গুরুত্বপূর্ণ। জবরদস্তির ঘটনা ভবিষ্যতে ঘটলে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে পার্থক্য তৈরি করে দেবে। সামরিক ও মনস্তাত্ত্বিক—দুইয়ের সমন্বয়েই গড়ে ওঠে স্মার্ট বা সাবলীল ক্ষমতা। সে ক্ষেত্রে এ দুটি পরস্পরবিরোধী না হয়ে বরং একটি অন্যটিকে শক্তি জোগায়। পুতিন এ দুটির সমন্বয় ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছেন। ইউক্রেনে রাশিয়ার নিষ্ঠুরতা এমন জোরালো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, যাতে জার্মানি দ্বিতীয় নর্ড স্টিম পাইপলাইন চুক্তি থেকে বের হয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র কয়েক বছর ধরে এ জন্য জার্মানির ওপর চাপ সৃষ্টি করেও ব্যর্থ হয়েছিল। পক্ষান্তরে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি (সাবেক অভিনেতা) অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে তাঁর দেশের বিপর্যয়ের চিত্র বিশ্বের তুলে ধরতে পেরেছেন। এতে করে তিনি শুধু সহানুভূতিই নিশ্চিত করেননি, বিভিন্ন দেশ থেকে সামরিক সরঞ্জামও পেয়েছেন।
সপ্তম, সাইবার সামর্থ্য অব্যর্থ বুলেট নয়। ২০১৫ সাল থেকে রাশিয়া ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সরবরাহ ও সঞ্চালন ব্যবস্থায় সাইবার হামলা চালিয়ে আসছে। অনেক বিশ্লেষক ধারণা করেছিলেন, আগ্রাসনের শুরুতেই রাশিয়া ইউক্রেনের অবকাঠামো ও সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ঝটিকা সাইবার হামলা চালাবে। যুদ্ধ শুরু থেকে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি সাইবার হামলার ঘটনা শোনাও গেছে। কিন্তু এর কোনোটিই বড় কোনো কিছু ঘটাতে পারেনি। ভায়াসাত স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক হ্যাক হওয়ার পর জেলেনস্কি স্টারলিংক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বাকি বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। এ ছাড়া প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা ইউক্রেনের সাইবার প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত করেছে। অষ্টম, এই যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ (সবচেয়ে প্রাচীন) শিক্ষা হচ্ছে যুদ্ধের ভাগ্য সব সময়ের জন্যই অনিশ্চিত। চার শতাব্দীর আগে, শেক্সপিয়ার তাঁর জুলিয়াস সিজার নাটকে যেমনটা বলেছিলেন, একজন নেতার জন্য ‘যুদ্ধের সর্বনাশ’ দেখে অশ্রু বিসর্জন করা এবং ‘যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া’ বিপজ্জনক কাজ। সংক্ষিপ্ত সময়ে যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি অতিমাত্রায় বিপজ্জনক। ১৯১৪ সালের আগস্ট মাসে ইউরোপের নেতারা প্রত্যাশা করেছিলেন, বড়দিনের ছুটিতে সেনারা ঘরে ফিরে যেতে পারবে। এর পরিবর্তে তাঁরা চার বছরের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সেই যুদ্ধে চারজন রাষ্ট্রনেতার মসনদ তছনছ হয়ে গিয়েছিল। খুব কাছের ইতিহাসের দৃষ্টান্ত হলো ইরাক যুদ্ধ। ২০০৩ সালে আমেরিকানরা যখন ইরাক আগ্রাসন শুরু করে, তখন ওয়াশিংটনের অনেক পর্যবেক্ষক বলেছিলেন, কয়েক দিনের মধ্যেই অভিযান শেষ হবে। কিন্তু সেই কয়েক দিন শেষে কয়েক বছর স্থায়ী হয়েছিল। সমাপ্ত
লেখক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct