কার পারমাণবিক সামর্থ্য কতটুকু, তার চেয়েও অংশীজনদের ইচ্ছার ওপর সেটা নির্ভর করে। পরমাণু যুদ্ধের উত্তেজনা থেকে পশ্চিমারা নিজেদের সরিয়ে নিতে পারে, কিন্তু সেটা হতে হবে সুনির্দিষ্ট বিষয়ের ভিত্তিতে। পুতিনের পরমাণু অস্ত্রের হুমকির কারণে পশ্চিমা সরকারগুলো ইউক্রেনে সেনা পাঠাতে বিরত রয়েছে। তবে এ সিদ্ধান্ত পারমাণবিক সামর্থ্যে রাশিয়ার আধিপত্য রয়েছে, এমনটা নির্দেশ করে না। কিন্তু পশ্চিমের কাছে ইউক্রেন গুরুত্বপূর্ণ হলেও প্রধান স্বার্থ নয়। এ নিয়ে লিখেছেন জোসেফ এস নাই। আজ প্রথম কিস্তি।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর সময় ভেবেছিলেন কয়েক দিনের মধ্যে কিয়েভ দখল করে নিতে পারবে তাঁর সেনাবাহিনী। ১৯৫৬ সালে বুদাপেস্টে এবং ১৯৬৮ সালে প্রাগে সোভিয়েতের আগ্রাসনের অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে বলেই ধরে নিয়েছিলেন পুতিন। কিন্তু সেটা হয়নি। যুদ্ধ এখনো প্রচণ্ড আকারে চলছে এবং কেউই জানে না কবে ও কীভাবে তা শেষ হবে। এ পরিস্থিতিতে কিছু পর্যবেক্ষক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন; অন্যরা আবার আগ্রাসনের জন্য রাশিয়াকে শাস্তি দেওয়ার ওপর জোর দিচ্ছেন। যদিও এর সবকিছুই নির্ভর করছে মাঠের বাস্তবতা মানে যুদ্ধের ফলাফল কী হয়, তার ওপর। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে নতুন ও পুরোনো মিলিয়ে কমপক্ষে আটটি শিক্ষা বিশ্বের নেওয়ার আছে।
প্রথম, পরমাণু যুদ্ধের উত্তেজনা প্রশমন। এটা সম্ভব। কার পারমাণবিক সামর্থ্য কতটুকু, তার চেয়েও অংশীজনদের ইচ্ছার ওপর সেটা নির্ভর করে। পারমাণবিক যুদ্ধের উত্তেজনা থেকে পশ্চিমারা নিজেদের সরিয়ে নিতে পারে, কিন্তু সেটা হতে হবে সুনির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে। পুতিনের পরমাণু অস্ত্রের হুমকির কারণে পশ্চিমা সরকারগুলো ইউক্রেনে সেনা পাঠাতে (যদিও যুদ্ধ সরঞ্জাম পাঠিয়েছে) বিরত রয়েছেন। তবে এ সিদ্ধান্ত পারমাণবিক সামর্থ্যে রাশিয়ার আধিপত্য রয়েছে, এমনটা নির্দেশ করে না। বরং এটা ইউক্রেন নিয়ে পুতিন ও পশ্চিমের ভাবনার যে পার্থক্য, তারই প্রতিফলন। পুতিনের কাছে ইউক্রেন রাশিয়ার প্রধানতম জাতীয় স্বার্থ, কিন্তু পশ্চিমের কাছে ইউক্রেন গুরুত্বপূর্ণ হলেও প্রধান স্বার্থ নয়। দ্বিতীয়, অর্থনীতির ক্ষেত্রে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা যুদ্ধ ঠেকাতে পারে না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বাণিজ্য ক্ষেত্রে বিশ্বের নেতৃত্ব দেওয়া দেশগুলো এই শিক্ষাকে খুব ভালোভাবেই গুরুত্ব দিয়ে আসছে। কিন্তু সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর গেরহার্ড শ্রোয়েডার এই নীতিকে উপেক্ষা করেন। তাঁর সরকার রাশিয়া থেকে আমদানি বাড়িয়েছিল এবং রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর জার্মানির নির্ভরতা তৈরি করেছিল। সম্ভবত তিনি ভেবেছিলেন, বাণিজ্য বন্ধন ভাঙলে দুই দেশের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হবে। কিন্তু অর্থনৈতিক এই আন্তনির্ভরশীলতা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি বাড়িয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে স্পষ্ট বিষয় হলো, এটা কোনোভাবেই যুদ্ধ ঠেকাতে পারে না।
তৃতীয়, অসম অর্থনৈতিক আন্তনির্ভরশীলতাকে অপেক্ষাকৃত কম নির্ভরশীল পক্ষ হাতিয়ার করে তোলে। অংশী দেশগুলোর মধ্যে ভারসাম্য থাকলে এই আন্তনির্ভরশীলতার ক্ষমতা খুব কম। রাশিয়া জ্বালানি রপ্তানি করে যে আয় করে, সেটা যুদ্ধের অর্থায়নে ব্যবহার করে। আবার ইউরোপ রাশিয়ার জ্বালানির ওপর এতটাই নির্ভরশীল যে সেটা পুরোপুরি বাদ দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। চতুর্থ, নিষেধাজ্ঞার ফলে আগ্রাসনকারী রাষ্ট্র ক্ষতির মুখে পড়লেও সেটি তাৎক্ষণিকভাবে আগ্রাসন ঠেকাতে পারে না। সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম বার্নস (রাশিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত) গত নভেম্বরে পুতিনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তিনি পুতিনকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, আগ্রাসন শুরু করলে রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হবে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। পুতিন সন্দেহ করে থাকতে পারেন যে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ব্যাপারে পশ্চিমাদের মধ্যে ঐকমত্য না-ও হতে পারে। (পক্ষান্তরে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং রাশিয়ার সঙ্গে এখন সহযোগিতা সীমিত করেছেন। যদিও রাশিয়ার দিক থেকে দাবি করা হয়েছে চীনের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে কোনো সীমা নেই। সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় পড়তে হতে পারে, এমন উদ্বেগ থেকেই সি চিন পিং এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
লেখক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct