অটোইমিউন ডিজিজ
ফৈয়াজ আহমেদ
অটোইমিউন ডিজিজ প্রায় সময়ই শনাক্ত করতে সমস্যা হয়। প্রতিটি মানুষের শরীরে প্রাকৃতিকভাবে রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা থাকে। এর কাজ হলো শরীরের ক্ষতি করে এমন কিছু- ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদি প্রবেশ করতে চাইলে তার সাথে লড়াই করে তাকে বাধা দেয়া। ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা অ্যান্টিবডি নিঃসরণ করে, শরীরের শত্রুকে মোকাবেলা করে। কিন্তু কেউ অটোইমিউন ডিজিজে আক্রান্ত হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভুল করতে থাকে। শত্রু এবং সুস্থ কোষের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারে না। তখন রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা উল্টো শরীরের সুস্থ কোষ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আক্রমণ করতে থাকে। অটোইমিউন ডিজিজ প্রায়শই শনাক্ত করতে সমস্যা হয়, দেরি হয় এবং রোগটি কখনোই পুরোপুরি নিরাময় করা যায় না। তবে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। কিন্তু তারপরও পারিপার্শ্বিক কারণে হঠাৎ খারাপের দিকে চলে যেতে পারে।অটোইমিউন ডিজিজ অনেক সময় বংশগত হয় থাকে। তবে যে কেউ বংশগত কারণ ছাড়াও আক্রান্ত হতে পারেন।
প্রধান উপসর্গ অটোইমিউন ডিজিজের চিকিৎসা দেন রিউমাটোলজি বিশেষজ্ঞ। মেডিসিন বিশেষজ্ঞরাও শনাক্তে সহায়তা করতে পারেন। এই রোগটির প্রধান কয়েকটি উপসর্গ: গিঁটে ব্যথা, গিঁট ফুলে যাওয়া, ত্বকে র্যাশ বা ফুসকুঁড়ি, ত্বক লালচে হয়ে যাওয়া, চুল পড়ে যাওয়া, সবসময় ক্লান্তি বোধ করা, খাবার রুচি চলে যাওয়া, ওজন কমা, রাতে শরীর ঘেমে যাওয়া, তলপেটে ব্যথা, হজমের সমস্যা, বারবার জ্বর ও গ্রন্থি ফুলে যাওয়া। যে ধরনগুলো সবচেয়ে বেশি দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস স্কুল অব মেডিসিন বলছে, অটোইমিউন ডিজিজের দু’শর বেশি ধরন রয়েছে। এর মধ্যে যে ধরনের অটোইমিউন ডিজিজে সবচাইতে বেশি মানুষ আক্রান্ত হন, তার একটি হলো রিউমাটয়েড আর্থরাইটিস। যা শরীরের নানা গিঁট আক্রান্ত করে। এতে গিঁট আড়ষ্ট হয়ে যায়, ব্যথা হয়, ফুলে যায়। এমনকি গিঁট বিকৃত ও বিকলাঙ্গ হয়ে যেতে পারে। এতে হাতের গিঁট সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। সরায়েসিস হলে শরীরের ত্বকে ফুসকুড়ি দেখা দেয়, চুলকানি হয়। চামড়ার বিভিন্ন অংশ মোটা ও খসখসে হয়ে যায়। লুপাস হলে গিঁট, ত্বক, কিডনি, হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক, ফুসফুস, রক্ত কণিকাসহ এক সঙ্গে অনেকগুলো অঙ্গ আক্রান্ত করতে পারে। এটি খুবই গুরুতর। ভাস্কুলাইটিস রক্ত সঞ্চালনকারী ধমনি ও শিরাকে প্রদাহের মাধ্যমে সরু করে তোলে। ধমনি ও শিরা যেহেতু হৃদযন্ত্র, কিডনিসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে রক্ত সঞ্চালন করে। তাই রক্ত পৌঁছাতে না পারলে এসব অঙ্গে গুরুতর ক্ষতি হতে পারে। ভাস্কুলাইটিস মাথা, ঘাড়, সাইনাস, নাক ও কানের রক্ত সঞ্চালন করে এমন শিরাও আক্রমণ করে। গ্রেভস ডিজিজে শরীরে থাইরয়েড হরমোন বেশি তৈরি হয়। একটি বড় অংশের চোখ বের হয়ে আসছে বলে মনে হয়। চোখ লাল হয়ে যায়, ব্যথা করে, দৃষ্টিশক্তি ব্যহত করে। নারীদের মাসিক অনিয়মিত হতে পারে। পুরুষদের যৌন ক্ষমতা আক্রান্ত হতে পারে। উদ্বেগ ও ঘুমের সমস্যা হতে পারে। যে কারণে শনাক্ত করতে সমস্যা অটোইমিউন ডিজিজ প্রায়শই শনাক্ত করতে সমস্যা হয়, এমনকি পশ্চিমা বিশ্বে যেখানে স্বাস্থ্য সেবা অনেক উন্নত সেখানেও। নানা ধরনের অটোইমিউন ডিজিজের উপসর্গ একই রকম। এই রোগের উপসর্গগুলো অনেকসময় বেশ হঠাৎ করে প্রকাশ পায়। ধরুন হার্ট বা কিডনির সমস্যা হলে নির্দিষ্ট কিছু উপসর্গ থাকে। কিন্তু বেশিরভাগ সময় অটোইমিউন ডিজিজ শনাক্ত করতে সমস্যা হয়। কারণ দেখা যায়, এর নির্দিষ্ট কোনও উপসর্গ থাকে না। অন্য অনেক শারীরিক সমস্যার সাথে এর উপসর্গ মিলে যায়।
যেমন-ক্লান্তি, চুল পড়ে যাওয়া, পেটের সমস্যাকে অনেক সময় গুরুত্ব দেয়া হয় না। দেখা যায়, অসংখ্যবার চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরও আসল রোগটি শনাক্ত হয়নি বা দেরি হয়েছে। কিছু ধরন আছে, যা নির্দিষ্ট অঙ্গ আক্রান্ত করে এবং যে অঙ্গ ধরে ওটাতেই থাকে। কিন্তু যে অটোইমিউন ডিজিজ শরীরের পুরো সিস্টেমকে আক্রান্ত করে সেটা শনাক্ত করা আরও সমস্যা। এটা শরীরের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আক্রান্ত করতে পারে। দেখা যাবে, আজকে লিভার ধরেছে, কিছুদিন পর হয়ত শরীরে রক্ত কমে গেছে। কিছুদিন পর দেখা যাবে, গিঁটে ব্যথা, মাস কয়েক পর হয়ত তার কিডনি বা হার্টে সমস্যা হয়েছে। এই ধরনটা খুবই বিপজ্জনক। শরীরে যেকোনও ধরনের ইনফেকশন হলে তা এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। নারীরা বেশি আক্রান্ত হন গবেষণা বলছে, পুরুষদের তুলনায় নারীরা অটোইমিউন ডিজিজে অনেক বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল বলছে, অটোইমিউন ডিজিজে আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই নারী। যার সঠিক কারণ এখনো নির্ণয় করা যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, এর সাথে সম্পর্ক রয়েছে নারীদের এক্স ক্রোমোজোম এবং সেক্স হরমোনের। বিশেষ করে এস্ট্রোজেন হরমোন। নারীর হরমোনে পরিবর্তনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো যেমন বয়ঃসন্ধিকাল, গর্ভাবস্থা ও মেনোপজ বা রজঃনিবৃত্তি। এই সময়গুলোতে নারীরা অটোইমিউন ডিজিজে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। তাছাড়া নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং হরমোনে পরিবর্তন পুরুষদের চাইতে বেশি হয়। এসব কারণে নারীরা বেশি আক্রান্ত হন বলে মনে করা হয়।প্রতিরোধের কোনও ব্যবস্থা নেই এই রোগ একবার হলে কখনোই পুরোপুরি নিরাময় করা যায় না। চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। সুষম খাবার বিশেষ করে আমিষ জাতীয় খাবার কিছুটা বেশি খেতে হবে, নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, কোনও ধরনের উপসর্গ হলেই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এটা আগে থেকে প্রতিরোধের কোনও ব্যবস্থা এখনো পর্যন্ত বিশ্বে আবিষ্কৃত হয়নি। রোগটা হয়ে গেলে আমরা চিকিৎসা দিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবো। কিন্তু আমার বংশে আছে, আমার যাতে রোগটা না হয় সেই ব্যবস্থা আমি করতে পারবো কি না, হলে চিকিৎসায় সেরে যাবে কি না, এই প্রশ্ন যদি করেন এর উত্তরটা হবে, ‘না’। সূত্র : বিবিসি
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct