দায়িত্বশীল
শংকর সাহা
__________
গত কয়েক মাস থেকে কোনোভাবে সংসার চালায়ি যাচ্ছে অবিনাশ। সেই শরীরে কঠিন অসুখ ধরা পরার পর থেকেই বেশি পরিশ্রম আর শরীরে সইছে না তার। একদিন বেশি পরিশ্রম করলে পরের দিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেনা অবিনাশ। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন শহরে গিয়ে বড় ডাক্তার দেখালে অসুখটি ভালো হয়ে যেতো। কিন্তু সে তো অনেক টাকা। বাড়িতে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা আর শহরে গিয়ে ডাক্তার! হাটে হাটে সামান্য একটু শাকপাতা বিক্রি করে কোনোমতে সংসার চালায় সে। ফটিক তারই সন্তান। বয়সে ছোটো হলেও এই কঠিন বাস্তবের সন্মুখে আজ সে পরিণত। আজ সে বাবার একমাত্র ভরসা। এ গাঁয়ের স্কুলেই সে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে।পড়াশোনায় ফটিক বরাবরই খুব ভালো। স্কুলে সকলের মধ্যমণি সে।
সেদিন সকাল থেকেই অবিনাশের শরীরটি খারাপ করেছে। পেটে অসহ্য যন্ত্রনা। এদিকে সকালে বাজারে শাঁকপাতা না নিয়ে বসলে সংসার চলবে না কিন্তু শরীর যে আর সইছে না তার। বাবার পাশে বসেই উদাসীন ভাবে তাকিয়ে থাকে ফটিক। ফটিক বুঝতে পারে বাবাকে আজ আর বাজারে যেতে দেওয়াটি ঠিক হবেনা। সে বায়না ধরে আজ বাজারে সে নিজেই বিক্রি করবে শাঁকপাতা। এর আগেও সে বাবার সাথে গেছে কয়েকবার বাজারে। আজ একপ্রকার জেদ করেই ব্যাগে শাঁকপাতা, কাঁচা কলা,মোচা এগুলো গুঁছিয়ে নিয়ে বাবা-মাকে প্রণাম করে বেরিয়ে পড়ে বাজারে। ছোট্ট ছেলেকে একা একা বাজারে পাঠাতে বাবা হিসেবে তারও যে মন সায় দেয়নি। কিন্তু সত্যি তো ঔই সামান্য জিনিসটুকু না বিক্রি করলে দুপুরের চালটুকু জুটবে না! বাজারে গিয়ে রমেশ কাকুর দোকানের পাশে ছোট্ট একটু জায়গায় ব্যাগে করে আনা জিনিসগুলো নিয়ে বসে পড়ে ফটিক। একদিকে এগুলো বিক্রির চিন্তা অন্যদিকে বাড়িতে অসুস্থ বাবা। ছোট্ট ফটিকের মাথায় যে আজ অনেক চিন্তা! দুএকজন খদ্দের পেয়েছে সে। গুনে গুনে দশটি টাকা সবে পেয়েছে। কিন্তু সবগুলো না বিক্রি করলে চাল-তেল-নুন যে জুটবে না তাদের। ভাবতে ভাবতে হঠাৎই কে যেন ডেকে বলে,“ কি রে ফটিক না? তুই আজ বাজারে এগুলো নিয়ে..? “ফটিক মুখ তুলে তাকাতেই বুঝতে পারে তিনি নিবারণ সরকার তারই স্কুলের হেডমাস্টার মশাই।“স্যর, বাবা আজ অসুস্থ। তাই আমিই এসেছি।এগুলো না বিক্রি করলে যে...! ফটিকের কথা সবটুকু বুঝতে পারেন মাস্টার মশাই নিবারণ বাবু।ফটিকের কাছ থেকে তিনি সব শাঁক গুলো কিনে নিয়ে বলেন চল আমার সাথে। তোকে বাড়িতে রেখে আসি.. “
ফটিক অপ্রস্তুত বোধ করলেও স্যরের সাথে সাইকেলে চেপে বাড়িতে আসে। এদিকে বাড়িতে গাঁয়ের স্কুলের হেডমাস্টার মশাই এসেছেন শুনেই অবিনাশ বাবু বিছানা ছেড়ে উঠতে যাবেন সেই সময় নিবারণ বাবু বলেন,“অবিনাশ, তুমি শুয়ে থাকো। উঠতে হবেনা। আজ বাজারে গেছিলাম।গিয়ে দেখলাম ফটিককে। ওর মুখ থেকে শুনলাম তোমার শরীর ভালোনা তাই দেখতে এলাম। “ফটিক মাস্টার মশাইকে বসার জন্যে একটি কাঠের টুল এগিয়ে দে। ‘অবিনাশ, ফটিক তোমার সোনার টুকরো ছেলে যেমন পড়াশোনায়, তেমনই দায়িত্বশীল।এইটুকু বয়সে ও আজ যেটি করলো হয়তো ওর চাইতে অনেক বড়রাও সেই ভাবনাটুকু মাথায় আনবে না..! অবিনাশ বাবুর চোখে বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। সে যে ফটিকেরই বাবা। কোনোদিন ছেলের ইচ্ছে গুলো পূরণ করতে পারেননি। দুবেলা শুধু দু মুঠো ভাতটুকুই পেয়েছে সে। দরজার আড়াল থেকে ফটিক মাস্টার মশাইয়ের সবটুকু কথা সে শুনছে। “ফটিক, এই পাঁচশ টাকা রাখ। বাবাকে কিছু ফল ও ওষুধ কিনে দিস.. “আজ ফটিকও কাঁদে। আজ তার নীরবতার কথাগুলোর হয়তো কেউ সাক্ষী রইলো না...
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct