স্ত্রী-প্রেম স্ত্রী-ভয়
এরসাদ মির্জা
_________________
পড়ন্ত বিকেলে ফুরফুরে হাওয়া গায়ে মেখে, বাড়ির ব্যালকনিতে বসে নিবিড়ভাবে ডুবে ছিলাম আরিফ আজাদের ‘নবি-জীবনের গল্প’ বইটিতে। কী অদ্ভূত জাদু রয়েছে লোকটার কলমে! খুব সাধারণ ও জানা বিষয়কে অদ্ভূত আঙ্গিকে বর্ণনা করতে দারুণ সিদ্ধহস্ত। ছোট্ট ছোট্ট বিষয়কে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে, পাঠকের মনোগ্রাহী করে তোলায় তাঁর রয়েছে অসাধারণ মুনশিয়ানাও। তাই স্বাভাবিকভাবেই, আরিফ আজাদের বই মানে, এক নাগাড়ে পড়ে ফেলতে পারলেই শান্তি আসে মনে। অতএব, সেদিনও ডুবে গেছিলাম আরিফ আজাদের শৈল্পিকবর্ণনায়। জানা বিষয়গুলো নতুনভাবে, নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে জানছিলাম, বুঝছিলাম। লেখনী শক্তির নিপুণতায় কী সুন্দরভাবে ব্যক্তিজীবনের সাথে মেলে ধরা হয়েছে প্রতিটি কাহিনীকে! একদম দেহ-মন নাড়িয়ে দেওয়ার মতো! পড়ছিলাম- সদ্য যৌবনে পা দেওয়া, তারুন্যে ভরপুর; চনমনে কিশোরী ও কনিষ্ঠ স্ত্রী আয়েশার (রাঃ) সাথে বৃদ্ধ নবির (সঃ) দৌড় প্রতিযোগিতার অতি পরিচিতি গল্পটি। আহ্, কী স্নেহ ও ভালোটাই না বাসতেন আয়েশাকে! শরীরের ভারে দ্রুত চলতেই যেখানে হাঁপিয়ে উঠতেন, সেখানে তিনি মা আয়েশার আবদারে লাগালেন দৌড়। নিজে হারলেন। আর স্ত্রীর মুখে ফোটালেন বিজয়ীর হাসি। সঙ্গে নিজেও হেসে উঠে জড়িয়ে ধরলেন আয়েশাকে। আর এইরুপে সুন্দরভাবে সেলিব্রেশন করলেন স্ত্রীর বিজয়ের মুহুর্তটি। পড়তে পড়তে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। কল্পনা করার চেষ্টা করলাম, বিশ্বনবী (সাঃ) ও মা আয়েশার (রাঃ) দৌড়ের সেই মহান দৃশ্যটি। যেখানে তিনি স্ত্রীর অদ্ভূত আবদারের মান্যতা দিয়ে দৌড়ছেন, হারছেন আর সাড়ম্বরে উদযাপন করছেন তাঁর বিজয়-মুহুর্তটি। আহ্, কতোই না ভাগ্যবান তারা, যারা নিজেদের স্ত্রীদের খুশির খাতিরে এমন ছোটখাটো কাজগুলিও করে থাকে! এটাও যে সুন্নাত-এ-রাসূল! নেকির কাজ! ভাবনার সাগরে ডুবে ছিলাম। খুঁজছিলাম, আমার ভবিষ্যতের হবু-স্ত্রীকে, আর কল্পনা করছিলাম এমন এক সুন্দর দৃশ্য, যেখানে হাসি-মজা, মান-অভিমান ও ঝুলিভরা আবদারে আমরা উপভোগ করছি এক পরম আনন্দের জীবন। ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠল। ব্যাঘাত ঘটল ভাবনায়। ফিরে এলাম চিরবাস্তবে। যেখানে হাসি-মজা, মান-অভিমান ও আবদার করার কেউ নেই। আছে শুধু একাকীত্ব ওবিষাদময় এক জীবন।
শাকিরের ফোন। আমার কলেজ-জীবনের বন্ধু। এখন গার্মেন্টসের একজন বড় ব্যবসায়ী। মনটা নেচে উঠল। পুরানোবন্ধুদের ফোন পেলেই আমার আনন্দের ঠিকানা থাকে না। আর শাকির তো ক্লোজ়েস্ট-ওয়ান! বছরখানেক আগে তার বিয়ে হয়েছে। বেশ রসিক ও ভদ্র ছেলে সে। স্ত্রীকে অগাধ ভালোবাসে। বাড়ির ছোটখাটো কাজে হাত লাগিয়ে স্ত্রীকে সহায়তা করে। তার সাথে খুনসুটি করে, মজা করে, এমনকি স্ত্রীর আবদারে কল্পনাতীত ও দুঃসাধ্য কাজও সে করে থাকে। সুন্নাত-এ-রাসূল পালন যে হয়ে থাকে! একদিনের ঘটনা- ফজরের নামাজের জন্য শাকির তার স্ত্রীকে ডাকলে, তার স্ত্রীর মাথায় একটি দুষ্টু বুদ্ধি খেলে যায়।সে শাকিরের গলায় আজান শুনবে মনস্থির করে ফেলে। তাই, নামাজের জন্য তাকে ডাকা হলে, সে চালাকি করতে থাকে। বলে, ‘আজান তো এখনও দেয়নি। আজান দিক তারপর উঠছি।’ তাকে বলা হয়,আজান হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে। কিন্তু সে উঠে না। বরং তখনই সে তার দুষ্টু বুদ্ধির সিক্কা ঘুমিয়ে বসে। বলে, ‘আমি তো আজান শুনিনি। আজান শুনব তখন ঠিক উঠব।’ কী আজব ব্যাপার! ‘তুমি শুনোনি বলে কি মুয়াজ্জিন আবার আজান দিবে?’ বললেই সে চোখ বন্ধাবস্থায় হাসতে থাকে। ঘুম-ভাঙাগলায় বলে, ‘মুয়াজ্জিন না দিলে, তুমি দাও। এখানে, আমার পাশে!’ বলে হাত দিয়ে ইশারা করে। কোনো উপায় না পেয়ে,সেদিন অগত্যা নাকি আজান দেয় শাকির! আর সকালে খেতে বসে মায়ের কাছে শুনতেও হয়, ‘কোনো দিন তো মসজিদের মাইকে হাতও দিলি না, আর ঘরে বসে বসে আজান তো বেশ দিচ্ছিস। একদম বড় মুয়াজ্জিন বনে গেছিস দেখছি!’ প্রত্যুত্তর করার কিছু ছিল না। লজ্জায় মাথা নুইয়ে নিয়েছিল শাকির। অপরদিকে রান্না ঘর থেকে কানে ভেসে এসেছিল স্ত্রীর বিরক্তিকর খিকখিক হাসি।
ঘটনাটি শুনে আমরা হেসে লুটোপুটি খাই। তারপর থেকে যখনই শাকিরকে দেখি, জিড়াবিড়ি করতে থাকি। তার আজান শোনার জেদ ধরি। তাকে আবদার করি একবার আজান দেওয়ার। কিন্তু আজ পর্যন্ত পূরণ হয়নি আমাদের কারো আশা।পরিবর্তেসে শোনায়, ‘পাগলিটার উপর সময় সময় খুব রাগ ধরে জানো। এমন এমন আবদার করে বসে কি বলবো, মনে হয় জোর ধমক দিই, মারি এক কিল, কিন্তু পারি না। তার আবদার পূরণ করেই ফেলি!’ আমরা তার কথা শুনে খুব হেসে ছিলাম। সাথে সেও হেসে ছিল। কিন্তু একটুপরেই সে আমাদের ভাবুক করে তুলেছিল। বলেছিল, ‘জানো, পাগলিদের এসব বিদঘুটে আবদার পূরণ করাও সুন্নাত। নেকির কাজ। তাই সে না মানলে, শেষমেশ তার আবদার রাখতেই হয়...।’ ফোনটা ধরার আগে শাকিরের এসব কথা স্মৃতিপটে ভেসে গেল। খেয়াল হলো, সে তো বিয়ের কথা পাড়বেই। তুলে ধরবে স্ত্রীর সাথে করা ছোটখাটো কাজে নেকির ফিরিস্তি। পরামর্শ দিবে বিয়েটা সেরে ফেলার। কিন্তু তার প্রশ্ন প্রতিহত করা যায়-ই বা কীভাবে? যাইহোক, শেষমেশ তার ফোনটা ধরলাম। জানতে পারলাম সে নিউ মার্কেটে এসেছে, তাই আমাকে যেতে হবে। সঙ্গে নাকি নুরুলও আছে। সেও কলেজ-ফ্রেন্ড। প্রেম করে বিয়ে করে এখন বেচারার ‘ঘরে কম বাইরেই বেশি সময় কাটে’ অবস্থা! দেখা হল তাদের সাথে। সিটি মার্ট, বাজার কলকাতা হয়ে ঢুকলাম গিয়ে শ্রীলেদার্সে। এস্কেলেটর ধরে উঠলাম উপরে। শাকির তার স্ত্রীর জন্য একজোড়া জুতো নিল। সঙ্গে হ্যাণ্ডব্যাগও। নুরুল নিল শুধু হ্যাণ্ডব্যাগ। আমাকে নিয়ে একটু মজাওকরল। বলল, ‘দেখে রাখো, কী কী সব কিনে দিতে হয়।’ বলে হেসে উঠল। আমিও হাসলাম, কিন্তুমুখ ফুটে কিছু বললাম না।
একটুবাদেএস্কেলেটর চড়ে ফিরে এলাম নিচুতলায়। দেয়ালের গায়ে সেঁটে থাকা সারি সারি জুতো থেকে একটা পাতলা-সোলের ফিতাওয়ালা জুতো হাতে তুলে শাকির দেখতে লাগল। বেশ সুন্দর জুতোটা। নুরুলেরও চোখে ধরল। সেও ছয় নম্বর সাইজের একটা হাতে তুলে নিল। তারপর জানতে চাইল আমার মত। কিন্তু আমার যে কী মনে হলো, আমি জুতো জোড়া হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে হাসতে লাগলাম। তারা অবাক হলো। জানতে চাইল, ব্যাপার কী? মিকি হাসি হেসেবললাম, ‘পরিস্থিতি বুঝেনেওয়া যেতেই পারে...।’ বলে চুপ হয়ে গেলাম। ওরা বিবাহিত হলে কী হবে, বুঝতে পারল না আমার কথার ইশারা। শুনালাম তখনওদের একটি কাহিনী। বললাম, ‘কিছুদিন আগে একটা গল্প শুনলাম। এক দম্পতি নাকি সাতাশ বছর পর ডিভোর্স ফাইল করেছে। আদালত এর কারণ জানতে চাইলে, পুরুষ লোকটি জানায়, তার স্ত্রী নাকি তাকে এটা ওটা ছুড়ে মারে। কিন্তু তার জন্য সাতাশ বছর পর কেন? এর উত্তরে লোকটা বলে, ‘আগে কিছু ছুড়লে মিস করে যেত, গায়ে লাগত না; কিন্তু এখন নিশানা ঠিক হয়ে গেছে, একটাও মিস যায় না।’ বলেই হেসে উঠলাম। তারাও হো হো করে হেসে উঠল। একটু পর শাকির বলল, ‘কিন্তু এই জুতো জোড়া নিলে “পরিস্থিতি বুঝে” নিতে হবে না কি যে বললে, তারমানে কী?’ আমি হাসলাম। জুতোটা আবার হাতে নিয়ে এদিক ওদিক দেখালাম। তারপর বললাম, ‘এই জুতো জোড়া যদি ধেয়ে আসে তোমার ‘পরে, কী হবে অবস্থা ভেবে দেখেছ? তাই, পরিস্থিতি...’ বলতে গিয়ে থেমে গেলাম। ফিক করেহেসে চেয়ে দেখলাম শাকিরের দিকে। দেখলাম, সেও মুচকিহাসছে। ঘন্টাখানেক পর যখন শ্রীলেদার্স থেকে বের হলাম,লক্ষ্য করলাম, শাকিরের হাতে দুটো ব্যাগ ধরা। একটায় ভরা স্ত্রীর জুতো-ব্যাগ আর অপরটায় তার ঐ পাতলা-সোলের ফিতাওয়ালা জুতো জোড়া। আর নুরুলের হাতে দেখলাম শুধু একটাই ব্যাগ- স্ত্রীর হ্যাণ্ডব্যাগ ভরা!
সূর্য ডুবে গেছে পশ্চিমাকাশে অনেক আগেই। তারকায় ভরে উঠেছে দিগন্ত আকাশ। সেই সাথেমানুষের ভিড়ে ভরে গেছে পুরো নিউ মার্কেট চত্বরও।চারদিকে থিকথিক করছে শুধু মানুষ আর মানুষ। সেই ভিড়ে গা ভাসিয়ে আমরা এসে পৌঁছালামএক ফুড কর্ণারে। অর্ডার করলাম তিনটি চাউমিন। খেতে খেতে উঠে এলো ফেলে আসা দিনের নানান কথা। কলেজ-জীবনের কথা।যোগাযোগে না থাকা সব বন্ধুদের কথাও। আহ্, কতই না সুন্দর ছিল সেই মুহুর্তগুলি!মন চাইল, ফিরে যাই সেই দিনে, কলেজ-জীবনে। একসাথে গিয়ে বসি আবার কলেজের বিস্তৃত সবুজ লনে, সব বন্ধু মিলে। ঐক্যতানে আবার হেসে উঠি সবে মিলে। তখনই নুরুলের কণ্ঠ কানে এলো, ‘এবার উঠি গো, বাড়ি ফিরতে দেরি হলে আবার কেলেঙ্কারি বাঁধাবে!’ বলেই নুরুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। চেহারায় তার বিষণ্ণতার ছাপ স্পষ্ট। তার মুখ পানে চেয়ে দেখতেই মন থেকে হারিয়ে গেল এতক্ষণের সব আনন্দ ও খুশি। বাসস্টাণ্ডে গিয়ে দাঁড়ালাম। হাওড়াগামী বাসে ওরা চড়ে বসল।হাত নেড়ে তাদের বিদায় জানিয়ে, আমি নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানেই।বাস চলতে শুরু করল, আরমুহুর্তেপথের বাঁকেহারিয়ে গেলতাদের নিয়ে। তখনই চোখের সামনে ভেসে উঠল, দুটি ভিন্ন ছবি, ভিন্ন জীবন। স্ত্রী-প্রেমের ছোঁয়ায় তরতর করে বেড়ে ওঠা এক সতেজ জীবন ও স্ত্রী-ভয়েন্যুব্জে পড়াতারুণ্যের এক নিস্তেজ জীবন!
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct