বর্ষার ফুল
সনাতন পাল
__________________
বর্ষার আকাশ মানেই জলভরা কালো মেঘের ঘনঘটা, আর চারিদিকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা, কখনও চারিদিকে অন্ধকার হয়ে আসা কখনও আবার খানিকটা সাদা হয়ে ঝেপে বৃষ্টি আসা। কখনও বা ঝমঝম শব্দ টিনের চালার নিচে শুয়ে শুয়ে শুয়ে শোনা । বৃষ্টি স্নানে গাছের সবুজ পাতায় নতুন ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ আছন্ন করে ফেলে চারপাশ। আর সন্ধ্যা হলেই চারিদিকে ঝিঝি পোকার ডাক। ফুলেরা কেউ সোজা হয়ে থাকে কেউবা মাথা নুইয়ে দুলে দুলে নাড়ে। একটানা বৃষ্টির একঘেয়েমি ছাড়াতেই যেন রঙিন ক্যানভাসে ভরিয়ে তোলে প্রকৃতি নিজেকে। আবার মেঘের কোলে রোদের হাসা । গাছে গাছে সবুজের সমারহে বৃষ্টি স্নানে নেচে ওঠে ফুলের গুচ্ছ। কখনো তা কদমের হলুদে আবার কখনো দোলনচাঁপা, শাপলা কিংবা কামিনী, দোপাটির আভায়। প্রেয়সীর হাতের মুঠোয় বৃষ্টি ভেজা কদম জানায় বর্ষার আগমন বার্তা। তাই বুঝি বর্ষাকে বলা হয় প্রকৃতির রানী। ঋতুচক্রের আবর্তনে গ্রীষ্মের প্রখর-তার পরই আসে বর্ষার আগমন। এ ঋতুর পুরোটা সময় জুড়েই থাকে নানা ফুলের পালাক্রমে আগমন। বিভিন্ন ফুলের রঙের ভিন্নতা এ যেন এক রামধনুর রঙে তুলিতে আঁকা এক দৃশ্যপট ফুলের গন্ধকে স্পর্শ করেছে।
বর্ষার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে গাছে গাছে দেখা মেলে কদম ফুলের। দেখতে সম্পূর্ণ গোল বৃত্তাকার ফুলটির মিষ্টি ঘ্রাণে মুখরিত করে তুলে বর্ষার বর্ষণময় দিনগুলি। মূলত আষাঢ় শ্রাবণ এ দুই মাসই কেবল দেখা মেলে এ ফুলের। বর্ষা ঋতুর আরেকটি ফুল হচ্ছে দোপাটি। এ ফুলগুলো কিছু ক্ষেত্রে জোড়ায় জোড়ায় হয়ে থাকে। আর রঙের দিক থেকেও নানা রঙের বাহারি পসরা-তে যেন নিজেকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে ফুলগুলো। কোনোটি লাল অথবা বেগুনি, আকাশি, নীল,সাদাসহ নানা রং হয়ে থাকে এ বর্ষা সুন্দরীর। মেঘ কালো বর্ষার দিনের আরেকটি ফুল হচ্ছে কামিনী। এর মিষ্টি ঘ্রাণে ম-ম করে ওঠে চারপাশ। ঝোপের মতো গাছের সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিয়ে থাকা সাদা ফুলগুলো মিষ্টি সুবাসের সঙ্গে স্নিগ্ধ-তাও ছড়ায় চারপাশে। মনের মলিনতা যেন মুছে যায় কামিনীর সিগ্ধতায়। অন্যদিকে কামিনী গাছ খুব একটি লম্বা হয়ে থাকে না। মে থেকে জুলাই পর্যন্ত মূলত এ ফুলের দেখা পাওয়া যায়। এসব ফুলের পাশাপাশি বর্ষার আরেকটি ফুল হচ্ছে দোলনচাঁপা। কিছু জায়গায় এ ফুলটি দোলনচাঁপা হিসাবেই বেশ পরিচিত। সাদা রঙের এ ফুলের বড় বড় প্রজাপতির মতো পাপড়ি বৃষ্টি ভেজার স্নিগ্ধতায় নিজেকে আছন্ন করে রাখে প্রকৃতির মাঝে। তাই হয়তো এ ফুলকে বাটারফ্লাই লিলি নামেও পরিচিতি দেওয়া হয়ে থাকে । বর্ষার আরেকটি আকর্ষণ হচ্ছে শাপলা। চারিদিকে জলে থই থই বর্ষায় এ সময়ে দেখা মিলে পুকুরে কিংবা ঝিলের জলে শাপলার। সাধারণত আমরা সাদা শাপলার সঙ্গেই বেশি পরিচিত, কিন্তু বর্ষার এ ফুলের আছে নজরকাড়া আরও বেশ কিছু রং। এ ছাড়া এতে রয়েছে আরও ৯০ ধরনের প্রজাতি। শাপলা অনেকেই সখ করে মালা কিংবা কানের দুলের মতো পরে থাকে বর্ষার আগমনকে স্বাগত জানাতে। খালে বিলে নতুন জলের আগমন জীবনের বার্তা পৌঁছে দেয় আরও অনেক জলজ উদ্ভিদের মাঝেও। বর্ষার রূপে রাঙিয়ে এভাবেই প্রকৃতিতে পালাক্রমে আসে ঋতু রানি সঙ্গে নিয়ে আসে কদম, বেলি, কেয়া কখনো বকুলের সুভাস মেখে। ঝরা বকুলের গন্ধ যখন জড়ায়ে ধরে বিষণ্ণতার গলা তখন হৃদয়কে স্পর্শ করে একরাশ ভালো লাগা। তখন হৃদয়ে প্রস্ফুটিত হয় মধুমালতির পাপড়ি। বর্ষায় নানা ফুলের নানা বর্ণ প্রকৃতির যে নব ক্যানভাস সৃষ্টি হয় তার সাথে নানা গন্ধ আমাদের মনে রকমারি অনুভূতি ময়ূরের পেখমের মত ডানা মেলে, যা থেকে মন নিজেই অনুভব করে বর্ষার সাথে অন্য ঋতুর পার্থক্য ঠিক কোথায়? বর্ষায় হরেক রকম ফুলের আবির্ভাব যদি না ঘটত তাহলে নিশ্চিত রূপেই বলা যায় যে বর্ষায় প্রকৃতির রূপের ছটা অনেকটাই কমে যেত। অবগুন্ঠন দ্বারা আবৃত বর্ষা সুন্দরীর রূপের ছটার বহিঃপ্রকাশ ঘটেই নানা গন্ধের নানা বর্ণের ফুলের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে। যে প্রকাশে কোনো কৃত্রিমতার ছাপ থাকে না, সবটাই স্বতঃস্ফূর্ত।
লেখক: শিক্ষক এবং বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct