মধ্যপ্রাচ্যে দুই মুসলিম শক্তিধর দেশ ইরান ও সৌদি আরবের সাথে দ্বন্দ্ব- সঙ্ঘাত স্থায়ী রূপ দেয়ার নানা আয়োজন ছিল। বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া সঙ্ঘাতে নানাভাবে জড়িয়ে যায় তুরস্কের মতো দেশও। সর্বশেষ, আরব বসন্তকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে শাসক পক্ষ এবং জনপ্রিয় ইসলামিস্টদের মধ্যে অস্তিত্বের লড়াই তৈরি করা হয়। ইসলামী আন্দোলন যাদেরকে পশ্চিমা শক্তি ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের ওপর কেমন হতে পারে তা নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ প্রথম কিস্তি।
বিশ্ব-পরিস্থিতি এখন একটি পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। চীন ও রাশিয়া বৈশ্বিক পর্যায়ে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা গ্রহণের ব্যাপারে সক্রিয় হতে শুরু করেছে প্রায় দশককাল আগে থেকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভূ-রাজনৈতিকভাবে রুশ-চীন অক্ষ আরো চ্যালেঞ্জিং ভূমিকা নিতে শুরু করে। এর একটি বড় ধরনের অবয়ব নেয়ার পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করে রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধ বিশ্বকে একটি সুস্পষ্ট মেরুকরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযান এখনো শেষ হয়নি। তবে এই যুদ্ধে কোনো পক্ষ সিদ্ধান্তকারী সাফল্য পাবে বলে মনে হয় না। পুরো ইউক্রেনকে নিয়ন্ত্রণে নেয়ার প্রচেষ্টা প্রথম ধাপে ব্যর্থ হওয়ার পর এখন দনবাস অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণে নেয়ার দ্বিতীয় দফার লক্ষ্য অর্জনের জন্য রাশিয়া লড়াই করছে। সেখানেও প্রবল প্রতিরোধের কারণে রাশিয়া জয় পাবে কি না সংশয় রয়ে গেছে। এই যুদ্ধের জয়-পরাজয় নিষ্পত্তিহীন রেখেই শেষ পর্যন্ত একটি সমঝোতা তৈরি হতে পারে। তবে এই সমঝোতা যাই হোক না, পরবর্তী বিশ্বরাজনীতি ও মেরুকরণে তা বিরাট প্রভাব ফেলতে পারে। এই যুদ্ধের আগে রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের যে সম্পর্ক ও লেনদেন চলে আসছিল তা আর ফিরে আসবে বলে মনে হয় না। রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধে চীন, রাশিয়াকে সীমিত সমর্থন জোগালেও যুদ্ধের প্রত্যক্ষ অংশীদার ছিল না। ফলে নতুন স্নায়ুযুদ্ধে চীনের সাথে পশ্চিমা শক্তির চূড়ান্ত শত্রুতা সৃষ্টির মতো মেরুকরণ এখনো তৈরি হয়নি। তবে সেই মেরুকরণের একটি সম্ভাবনা রয়েছে তাইওয়ান ইস্যুকে কেন্দ্র করে। তাইওয়ান নিয়ে উত্তেজনা সাম্প্রতিক সময়ে কথামালা বা হুমকি উচ্চারণের পর্ব পেরিয়ে সামরিক মহড়াপর্যায়ে উপনীত হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পরিণতি নিয়ে বেইজিং যথেষ্ট সতর্ক হলেও তাইওয়ান ইস্যুটি চীনের জন্য সমঝোতার অযোগ্য বিষয়। এর স্থিতাবস্থা বজায় রেখেই কেবল সঙ্কটটিকে পেছানো যেতে পারে। ইউক্রেন ইস্যুর মতো তাইওয়ান ইস্যুর একটি নিষ্পত্তি আগে বা পরে হবে। চীনা নীতি নিয়ে আমেরিকান পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেনের সাম্প্রতিক নমনীয় মন্তব্যে মনে হতে পারে মারাত্মক এক পরিণতির মধ্য দিয়ে যাওয়া বিশ্বে আরেকটি প্রলঙ্করী যুদ্ধ বাধাতে চাইছে না যুক্তরাষ্ট্র। বেইজিংয়ের মনোভাবও একই রকম বলে মনে হয়।
এখন প্রশ্ন হলো- এই নতুন বিশ্ব-পরিস্থিতিতে মুসলিমবিশ্বের প্রতি দুই পক্ষের দৃষ্টিকোণ কী হবে? এর প্রভাব কতটা কিভাবে পড়বে মধ্যপ্রাচ্যে? পুরনো ঠাণ্ডা লড়াইয়ের পরবর্তী সময়টি ইসলামিক দুনিয়ার জন্য ছিল সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়কর। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র বলয় তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক উভয় ক্ষেত্রে পরবর্তী দুনিয়ায় ইসলামকে বৈশ্বিক নেতৃত্বের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করে। দ্বিতীয় জর্জ বুশের আমলে বিশ্বব্যাপী যে ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ লড়াইয়ের সূচনা করা হয় তার আওতায় আফগানিস্তান ও ইরাকে অভিযান চালানো হলো। মধ্যপ্রাচ্যে দুই মুসলিম শক্তিধর দেশ ইরান ও সৌদি আরবের সাথে দ্বন্দ্ব- সঙ্ঘাত স্থায়ী রূপ দেয়ার নানা আয়োজন ছিল। বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া সঙ্ঘাতে নানাভাবে জড়িয়ে যায় তুরস্কের মতো দেশও। সর্বশেষ, আরব বসন্তকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে শাসক পক্ষ এবং জনপ্রিয় ইসলামিস্টদের মধ্যে অস্তিত্বের লড়াই তৈরি করা হয়।
এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান প্রশাসনের বিদায়ের পর জো বাইডেনের ডেমোক্র্যাট প্রশাসন দায়িত্ব গ্রহণ করে। বাইডেনের নতুন সময় আমেরিকান পররাষ্ট্র দৃষ্টিভঙ্গিতে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তনের সঙ্কেত আগে থেকেই দেয়া হয়েছিল। আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহারের পর ইউক্রেন যুদ্ধে ন্যাটোর সক্রিয়তাবাদী ভূমিকা পুরো পশ্চিমা শক্তিকে নতুন মেরুকরণে নিয়ে যায়। প্রশ্ন হলো- নতুন এই ধারায় ইসলামিক বিশ্বের ব্যাপারে কী দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে পাশ্চাত্যের আর রুশ-চীন অক্ষের মনোভঙ্গি এই শক্তির প্রতি কেমন কী হতে পারে আর এর প্রভাব ইসলামী আন্দোলন যাদেরকে পশ্চিমা শক্তি ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের ওপর কেমন হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা দরকার।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct