পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা-সংকট
মজিবুর রহমান (প্রধানশিক্ষক, কাবিলপুর হাইস্কুল, কাবিলপুর, সাগরদিঘি, মুর্শিদাবাদ)
_________________________________________________
‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্রে রাজার নির্দেশে উদয়ন পণ্ডিতের পাঠশালা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ রাজার আশঙ্কা ছিল- “এরা (প্রজারা) যত বেশি পড়ে তত বেশি জানে তত কম মানে”। তাই মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য রাজার পক্ষ থেকে প্রচার করা হতে থাকে- “লেখাপড়া করে যেই, অনাহারে মরে সেই”। সত্যজিৎ রায় (১৯২১-১৯৯২) শাসকের যে অভিসন্ধি ফাঁস করেছেন, লিও টলস্টয়ের (১৮২৮-১৯১০) পর্যবেক্ষণের সাথে তার যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে- “মানুষের অজ্ঞানতার মধ্যেই সরকারের শক্তি নিহিত রয়েছে। সরকার সেটা জানে এবং সেজন্য সরকার সত্যিকারের জ্ঞানচর্চার বিরোধিতা করে”। বামফ্রন্ট সরকারের শিক্ষামন্ত্রী কান্তি বিশ্বাস (১৯৩২-২০১৬) তাঁর ‘আমাদের শিক্ষা’ গ্ৰন্থে কায়েমী স্বার্থের কারণে শিক্ষা বিস্তারের বিরোধিতা করার একটা বাস্তব ঘটনার উল্লেখ করেছেন- “পরাধীন ভারতে অবিভক্ত বঙ্গ প্রদেশের আইন সভায় যখন প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের জন্য ১৯২৮ সালে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা একটি বিল উত্থাপন করেছিল- জমিদারনন্দন শিবশেখরেশ্বর রায় আইন সভায় বলেছিলেন- ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য যাঁরা শতকরা শতজনই শিক্ষিত, এ আইনে তাঁরা কিছু উপকৃত হবেন না। মুসলমান, নমঃশূদ্র এবং অন্যান্য নিম্ন সম্প্রদায়ের লোকেরাই উপকৃত হবে”। বহু আলোচনা পর্যালোচনার পর ১৯৩০ সালের ২৬শে আগস্ট যখন প্রাথমিক শিক্ষা আইন অনুমোদন করার জন্য শিক্ষামন্ত্রী নাজিমুদ্দিন বিলটি ভোটে দেন তখন ৫০জন হিন্দু সদস্যই (সকলেই জমিদার ও উচ্চবর্গীয় পদমর্যাদাসম্পন্ন) এক যোগে আইন সভা থেকে প্রতিবাদে বেরিয়ে যান- একমাত্র মুসলমান বিধায়কদের ভোটে বাংলার আইন সভায় প্রদেশের প্রথম প্রাথমিক শিক্ষা আইন বিধিবদ্ধ হলো। মন্ত্রিসভার একমাত্র হিন্দু সদস্য শিবশেখরেশ্বর রায় প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের এই সর্বনাশা (?) আইন অনুমোদনের প্রতিবাদে মন্ত্রী পদে ইস্তফা দেন।” শিক্ষার বিরুদ্ধে আজও ষড়যন্ত্র বন্ধ হয়নি! আজও অনেকেই জনসাধারণের শিক্ষাগ্ৰহণে বিপদের আশঙ্কা দেখে! স্বাধীন ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে শিক্ষা রয়েছে যুগ্ম তালিকায়। সেজন্য প্রতিটি রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা প্রভাবিত হয়। কেন্দ্রের মোদী সরকার ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’ প্রণয়নের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থার পূর্ণ বেসরকারিকরণের পরিকল্পনা গ্ৰহণ করেছে। এই সরকার যেভাবে জলের দরে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রি করে তাতে ‘অলাভজনক ও অনুৎপাদক’ শিক্ষার দায়িত্ব কাঁধ থেকে সরিয়ে ফেলতে চাইবে সেটাই স্বাভাবিক। বেসরকারি সংস্থার হাতে পড়ে শিক্ষা পণ্য হিসেবে যত মহার্ঘ হবে তা ক্রয় করার অক্ষমতার কারণে মেহনতি মানুষের ছেলেমেয়েরা শিক্ষার অধিকার থেকে তত বঞ্চিত হবে। তাই পরিকল্পিতভাবে অনলাইন শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে প্রথাবদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থাকে বেহাল করে তোলা হচ্ছে।ই-লার্নিংয়ের প্রসার ঘটিয়ে শ্রেণীকক্ষের পঠনপাঠনের উৎকৃষ্ট ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হচ্ছে।এর ফলে দেশজুড়ে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী পদের ব্যাপক সংকোচন ঘটছে এবং দেশের বেকার সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।কেন্দ্রের বর্তমান শাসক দল আদর্শগত ভাবে সাম্প্রদায়িক। সেজন্য তাদের শিক্ষা নীতিও ধর্মনিরপেক্ষ নয়। তারা শিক্ষার গৈরিকীকরণ করতে বদ্ধপরিকর। এরই অঙ্গ হিসেবে ভারতীয় সভ্যতার বিকাশে অহিন্দু , বিশেষ করে মুসলমান শাসকদের, অবদানকে অস্বীকার করার চেষ্টা হচ্ছে। মোঘল আমলকে ইতিহাসের পাঠ্য থেকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে।ওই আমলের সৌধগুলোকে কেন্দ্র করে বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। বহুত্ববাদের ভারতকে হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থানের একমাত্রিক দর্শনে সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে। শাসকদলের মন্ত্রীসান্ত্রীরা হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাসকে বৈজ্ঞানিক সত্যের থেকে বড় করে দেখাতে চাইছেন।জ্যোতিষ শাস্ত্র আর সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।উচ্চ শিক্ষায় গবেষণা ও যুক্তি-তর্কের পরিসর ছোট করে দেওয়া হচ্ছে। মুক্তচিন্তার শিক্ষার্থীদের দেশদ্রোহীতার মিথ্যা অভিযোগে কারাবন্দি করা হচ্ছে। হিন্দুত্ববাদী শাসকরা আধুনিক ভারতকে বৈদিক ভারতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন।উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া একটা জাতির সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, সাম্প্রদায়িকীকরণ এবং অবৈজ্ঞানিকীকরণ ভারতের অগ্ৰগমনের পথে নিশ্চিতভাবেই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বর্তমান রাজ্য সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত আপত্তিজনক। বিগত এক দশকে এ রাজ্যের শিক্ষা পরিস্থিতির অনেক অবনমন ঘটেছে। স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি সর্বত্র পড়াশোনার পরিবেশ নষ্ট হয়েছে।শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তুলে দিয়ে দলতন্ত্র কায়েম করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনের উপর সরকারি হস্তক্ষেপ আরও বৃদ্ধি করার জন্য রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান রাজ্যপালের পরিবর্তে প্রশাসনিক প্রধান মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটর হবেন শিক্ষামন্ত্রী। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্মে অনিয়ম ও দুর্নীতি বাড়বে এবং ‘কাটমানি কালচার’ কায়েম হবে। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিগ্ৰহ এবং দীর্ঘদিন ধরে চলা অচলাবস্থার পেছনেও আর্থিক কারণ রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। আজকাল নন-ম্যাট্রিক লোকেরা কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি হয়ে অধ্যক্ষ-অধ্যাপকদের ধমকাচ্ছেন। কোথাও গাছে বেঁধে কোথাও জগ ছুঁড়ে শিক্ষকদের শারীরিক ভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে। কয়েক বছর হল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র সংসদ তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শাসকদলের ছাত্রনেতাদের ক্যাম্পাসে দৌরাত্ম্য বন্ধ হয়নি।ছাত্র ভর্তির সময় তারা তোলা তুলছে।কলেজ সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রচণ্ড অনিয়মিত হয়ে পড়েছে।অস্থায়ী আংশিক সময়ের শিক্ষক দিয়ে কোনো রকমে কাজ চালানো হচ্ছে।অন্যদিকে রাজ্যে বিভিন্ন ধরনের বেসরকারি কলেজ ইউনিভার্সিটি বেড়েই চলেছে। কোভিড-১৯ আবহের অজুহাতে পড়াশোনার চরম ক্ষতিসাধন করা হয়েছে এ রাজ্যে। প্রথাবদ্ধ ও প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার গুরুত্বটাই ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। পঠনপাঠনের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে সরকারের তীব্র অনীহা সংশ্লিষ্ট সকলকে বিস্মিত করেছে। স্কুল কলেজে ক্লাস শুরু করার দাবিতে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সংগঠনকে বারবার পথে নামতে হয়েছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর খোলা হলেও তিন-চার দিন একটু বেশি গরম পড়েছে বলে মুখ্যমন্ত্রী দেড় মাস ছুটি ঘোষণা করে দিয়েছেন। কারণে অকারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুধু ছুটি আর ছুটি। ছুটি দিতে এমন ছটফটানি আগে কখনও দেখা যায়নি। শ্রেণীকক্ষের পঠনপাঠন বন্ধ কিন্তু একটার পর একটা প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলতেই আছে। পড়াশোনার জন্য পড়ুয়াদের স্কুল আসা নিষেধ হলেও প্রকল্পের কাজে আসতে বাধা নেই। পড়ুয়াদের কাছে এখন পড়াশোনার চেয়ে প্রকল্পের গুরুত্ব বেশি। সবুজ সাথী, ঐক্যশ্রী, শিক্ষাশ্রী, কন্যাশ্রী প্রকল্পের সুবিধা ভোগের দিকে যত নজর থাকে ভালভাবে পড়াশোনা করার ব্যাপারে তত জোর থাকে না। শিক্ষার্থীদের মানসিক গঠনের এই অবনমন খুব দুশ্চিন্তার বিষয়।
কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা নীতির সঙ্গে তাল রেখে রাজ্য সরকারও অনলাইন ক্লাসকে উৎসাহ প্রদান করছে। কিন্তু আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত অসুবিধার কারণে একটা বড় অংশের শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারে না। তাছাড়া বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষের অভ্যন্তরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর শারীরিক উপস্থিতিতে পঠনপাঠন যতটা ফলপ্রসূ হতে পারে অনলাইনে সেটা সম্ভব নয়। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত আনুসঙ্গিক বিষয়গুলো সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের অবহিত হওয়ার জন্যও তাদের নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসা দরকার। অনলাইনের দূরশিক্ষা পড়ুয়াদের পূর্ণ মানুষ করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা হতে পারে না। ইতিমধ্যেই অনলাইনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।রাজ্যের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা অনলাইন পরীক্ষার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে। তারা পরীক্ষাকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রত্যক্ষ নজরদারিতে পরীক্ষায় বসতে অস্বীকার করছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, পড়াশোনা না হওয়ার কারণে পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালো হয়নি বলে তারা পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করতে চাইছে। এ এক ভয়ঙ্কর মানসিকতার উদ্ধত প্রকাশ!এ প্রসঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ দ্বারের দেওয়ালে লেখা পর্যবেক্ষণ উদ্ধৃত করা যেতে পারে- “কোনো জাতিকে ধ্বংস করার জন্য পারমাণবিক হামলা বা ক্ষেপণাস্ত্রের দরকার নেই। বরং সেই জাতির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় প্রতারণার সুযোগ দিলেই হবে। কারণ এই ভাবে পরীক্ষা দিয়ে তৈরি হওয়া ডাক্তারদের হাতে রোগীর মৃত্যু হবে; ইঞ্জিনিয়ারদের দ্বারা তৈরি দালান, ইমারত ধ্বংস হবে এবং অর্থনীতিবিদদের দ্বারা দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দেউলিয়া হবে। এছাড়া বিচারকদের হাতে বিচারব্যবস্থার কবর রচনা হবে। সুতরাং শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়া মানে হল একটি জাতির অবলুপ্তি”। এখন স্কুলের টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফরম ফিলাপের দাবিতে ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের আন্দোলন করতেও দেখা যায়। কোথায় গেছে এ রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা! স্কুল-মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর প্রচুর পদ শূন্য হয়ে পড়ে রয়েছে। নিয়োগ নেই। শিক্ষার্থী সংখ্যার অনুপাতে নতুন শিক্ষক পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে না। উদাহরণ স্বরূপ, দশ বছর আগে একটা বিদ্যালয়ে হয়তো ২০০০ ছাত্রছাত্রীর জন্য অনুমোদিত সহকারী শিক্ষক পদের সংখ্যা ছিল ৫০।দশ বছর ধরে বাড়তে বাড়তে বর্তমানে সেই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা হয়েছে ৪০০০।ছাত্র সংখ্যার নিরিখে অনুমোদিত শিক্ষক পদের সংখ্যা ১০০ হওয়া উচিত। কিন্তু তা ৫০ই রয়ে গেছে আর শূন্য পদে নিয়মিত নিয়োগ না হওয়ার জন্য বাস্তবে (in position) হয়তো ৫০-এর বদলে ৪০ জন শিক্ষক আছেন। বামফ্রন্ট সরকার ১৯৯৭ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগের একটি অত্যন্ত উৎকৃষ্ট ব্যবস্থা প্রবর্তন করে।এস এস সি-র মাধ্যমে প্রতিবছর হাজার হাজার ছেলেমেয়ে বিদ্যালয়ে চাকরি পেয়েছেন। অনিয়ম দুর্নীতি বঞ্চনা বৈষম্যের কোনো অভিযোগ ওঠেনি। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগের সেই অসাধারণ ব্যবস্থাটিকে কার্যত ধ্বংস করে দিয়েছে। গত এগারো বছরে একবারও কমিশন স্বচ্ছতার সঙ্গে সন্তোষজনক ভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিচালনা করতে পারেনি। যে দু’তিনবার নিয়োগ হয়েছে তাতে অজস্ত্র অভিযোগ উঠতে এবং আদালতে কমিশন তথা সরকারকে জেরবার হতে দেখা গেছে।এস এস সি-র চেয়ারম্যানের মর্যাদাপূর্ণ পদটি মিউজিক্যাল চেয়ারে পরিণত হয়েছে।কে কবে ঐ পদে বসেন আর কবে পদত্যাগ করেন তার হিসাব রাখাই কঠিন।
গত বছরের আগস্ট মাস থেকে উৎসশ্রী পোর্টালের মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের যে বদলি পদ্ধতি চালু হয়েছে তাতে সুষ্ঠু পরিকল্পনার যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।গ্ৰামীণ এলাকার স্কুলগুলো থেকে প্রচুর শিক্ষক বদলি নিয়ে চলে যাচ্ছেন শহর ও শহরতলীর স্কুলে। এর ফলে গ্ৰামাঞ্চলের স্কুলগুলো অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এমনিতেই গ্ৰামাঞ্চলের স্কুলগুলোর শূন্য পদের সংখ্যা শহরাঞ্চলের স্কুলগুলোর তুলনায় অনেকটা বেশি। নতুন বদলি-ব্যবস্থায় গ্ৰাম-শহরের বৈষম্য নিশ্চিতভাবেই আরো বাড়বে।এই মুহূর্তে গ্ৰামের দিকে এমন অনেক স্কুলের সন্ধান পাওয়া যাবে যেখানে যতগুলো সেকশন আছে তত জন শিক্ষক নেই; একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর বিষয়গুলো পড়ানোর শিক্ষক বাড়ন্ত।শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনুযায়ী যত জন শিক্ষক থাকা দরকার বাস্তবে তার এক-চতুর্থাংশ শিক্ষক নিয়ে কোনও রকমে দায়সারাভাবে স্কুল চলছে।গ্ৰাম-বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা একদম ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে গেছে।গ্ৰামের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসক থাকেন না, এখন গ্ৰামের স্কুলে শিক্ষক থাকবেন না।গ্ৰাম তবে ‘গেঁয়ো’ হয়েই থাক! সম্প্রতি এস এস সি-র মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতির হদিস মিলছে।রাজ্যের শাসকদলের নেতামন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের আধিকারিকরা এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানা যাচ্ছে। লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে চাকরি বিক্রি করা হয়েছে। কোনো নিয়ম নীতি মানা হয়নি।পরীক্ষায় না বসে অথবা সাদা খাতা জমা দিয়ে অনেকেই চাকরি পেয়েছে। Empanelled অথবা Waiting list-এ নাম না থাকা সত্ত্বেও চাকরি হয়েছে। তালিকার ক্রমিক নম্বর ভেঙে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে।এই সব অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে অনেক যোগ্য ছেলেমেয়ে চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাঁরা কলকাতার রাজপথে অবস্থান আন্দোলন করছেন। চরম অনিয়ম করে নিয়োগপত্র পাওয়ার কারণে আদালতের নির্দেশে কয়েকজনকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষা ক্ষেত্রে একটা সাংঘাতিক অস্থির, অরাজক ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কথায় আছে- শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড।কাজেই শিক্ষা ক্ষেত্রে সুস্থিতি ফিরে না এলে এবং শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন না ঘটলে বাঙালি জাতির মেরুদণ্ডটা নিশ্চিতভাবেই দুর্বল হয়ে পড়বে। বাংলায় একটা উন্নত সমাজ গড়ার স্বার্থেই আমাদের সকলের শিক্ষার ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি দেওয়া দরকার। মানুষের সচেতনতা ছাড়া একটা অত্যন্ত খারাপ পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব নয়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct