বেহায়া
গোলাম মোস্তাফা মুনু
_______________
আজ সকাল থেকে আব্দুল মাতিন ধীরগতিতে সেলাই কাজ করছে। যেন কাজে মন বসে না তার। সর্দির জন্য তার মাথা ব্যথা। কাজে আসার পূর্বে ওষুধ খেয়েছে কিন্তু আশানুরূপ ফল হয়নি। তার ইচ্ছা করছে কাজ ছেড়ে বাড়ি চলে যাওয়ার। কিন্তু কাজ ছেড়ে গেলেও হবে না। কারণ, মাস্টার অর্থাৎ দোকানের মালিক বিপাকে পড়ে যাবে। আজকেই তিনজনের জামাপ্যান্ট ডেলিভারি করতে হবে। খদ্দের সময়মতো ডেলিভারি না পেলে মাস্টারকে বকাবকি করবে। দোকানে আব্দুল মাতিনই একমাত্র কারিগর। মাস্টার একা এতটা কাজ করতে পারবে না। এমন চিন্তা ভাবনা করে মাথায় ব্যথা নিয়ে আব্দুল মাতিন সেলাই কাজ করতে থাকে। দুপুর নাগাদ আব্দুল মাতিনের মাথা ব্যথা কিছুটা কমে। মনে অনেক শান্তি পায় সে। এবার সে দ্বিগুণ হাত চালিয়ে সেলাই করতে শুরু করে। বিকাল গড়িয়ে যায়। তখনও অনেকটা কাজ পড়ে রয়েছে। সাথে মাস্টারও কাজ করছে। কাজ করতে করতে মাস্টার আব্দুল মাতিনকে নির্দেশ দেয়, ‘মাতিন, তুমি এখন সেলাই কাজ রেখে দাও। যেগুলো সম্পূর্ণ সেলাই হয়ে গেছে সেগুলো ইস্ত্রি করতে শুরু করো।’
মাস্টারের নির্দেশ মতো কাজ শুরু করে আব্দুল মাতিন। মাস্টার বার বার ঘড়ির দিকে দেখতে থাকে। রাত আটটার মধ্যে কাজ সম্পন্ন করতেই হবে। কাজ তখনও কিছু বাকি। আব্দুল মাতিনকে সে আবার নির্দেশ দেয়, ‘হাত চালিয়ে কাজ করো মাতিন। তা না হলে কাষ্টমারের মুখে কথা শুনতে হবে।’ মাস্টারের নির্দেশ মতো বেশি তাড়াতাড়ি ইস্ত্রি করতে গিয়ে প্রায় চার আঙ্গুল পরিমাণ জামা পুড়ে যায়। এমন মুহূর্তে আব্দুল মাতিন কী করবে ভেবে পায় না। হাতে সময় থাকলে জামার নতুন কাপড় কিনে এনে সেলাই করে নিত। মাস্টারকে জানতেই দিত না। কিন্তু হাতে একদম সময় নেই। অবশেষে আব্দুল মাতিন ভীত কন্ঠে মাস্টারকে বলে, ‘মাস্টারদা, একটু বেশি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কাজ খুব খারাপ হয়ে গেল।’ বলে সে মাস্টারকে জামার পোড়া জায়গাটা দেখালো।ক্ষতিটা দেখে মাস্টার ক্রোধে জ্বলে ওঠে। সেলাই মেশিন থেকে উঠে এসে হিতাহিত জ্ঞান ভুলে গিয়ে আব্দুল মাতিনের গালে এক চড় বসিয়ে দেয়। তার সাথে সাথে সে বকাবকিও শুরু করে। আব্দুল মাতিন নীচে মুখ করে নীরবে শুনতে থাকে। মুখে কোনো ভাষা নেই তার। মাস্টারের হাতে মার খেয়ে সে খুব অপমান বোধ করে। মাস্টার এবং আব্দুল মাতিন তারা দুজনই প্রায় সমবয়সী। বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে।বহুদিন ধরেই আব্দুল মাতিন সেখানে কাজ করে। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অর্থের অভাবে নিজের দোকান করতে পারেনি। মাস্টারও ইদানিং আর্থিক অনটনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। তার নিজের দোকান হলেও পূর্বের তুলনায় অর্ডার খুব কম পাচ্ছে। কোনো কোনো দিন কয়েকটা অর্ডার একসাথে পেয়ে যাচ্ছে তো খদ্দের আবার মাস্টারকে বেশি সময় দিচ্ছে না। ফলে মাস্টারেরও মন-মেজাজ ইদানিং ভালো থাকে না। তবে এতদিন সে আব্দুল মাতিনকে উঁচু গলায় কথা পযর্ন্ত বলেনি। আব্দুল মাতিন নীরবে বাকি কাজগুলো সম্পন্ন করে। তখন রাত আটটা। আব্দুল মাতিন মাস্টারকে মৃদু স্বরে বলে ওঠ, ‘মাস্টারদা, কাল থেকে আমি কাজে আসবো না। যে জামাটা নষ্ট হয়েছে সেটার ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমার মজুরি থেকে কেটে নিয়ে আমাকে হিসাব বুঝিয়ে দিলে ভালো হয়।’ বলে সে নীচে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
মাস্টার খানিক নীরব থাকার পর কোমল সুরে বলে, ‘মাতিন, অর্ধেক আমি সহ্য করছি, আর অর্ধেক তুমি সহ্য করো।’ বলে সে আব্দুল মাতিনকে হিসাবপত্র বুঝিয়ে দেয়। আব্দুল মাতিন প্রতিদিনই কাজ ছাড়ার পর মুখরোচক খাবার কিনে বাড়ি ফিরে। আজও নিয়ে এসেছে। স্ত্রী এবং ছয় বছরের পুত্র মিলে তৃপ্তি সহকারে খেতে শুরু করে। আব্দুল মাতিনকেও খেতে বলে স্ত্রী। কিন্তু সে আজ খেলো না। আজ তার মনের মধ্যে খুব অশান্তি। সেই মার খাওয়ার কথা তার বার বার মনে পড়ে। একবার তার ইচ্ছা হয় ঘটনাটা স্ত্রীকে শোনায়। মনটা খানিক হালকা হবে। পরক্ষণেই সেই সিদ্ধান্ত বদলে নেয়, ‘না! এই অপমানের কথা কাউকে বলা যাবে না।’ আব্দুল মাতিন রাতে ভালো করে খাবারও খেতে পারল না। তাড়াতাড়ি শুয়ে যায়। শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে, ‘মাস্টারদার দোকান তো ছেড়ে দিলাম। কাল থেকে কার দোকানে কাজ করবো? এলাকার সব দোকানেই তো কারিগর রয়েছে! কারও দোকানে তো ফাঁকা দেখছি না!’ এমন সময় তার স্ত্রী বলে ওঠে, ‘সরষের তেল শেষ হয়ে গেছে। চালও প্রায় শেষ। কোনো রকমে কালকের দিনটা হবে। একদিন আগেই বিষয়টি তোমার মাথাতে দিয়ে দিলাম।’স্ত্রীর কথা শুনে আব্দুল মাতিনের চিন্তাভাবনা আরও বেড়ে যায়। পরেরদিন। সকাল আটটা। মাস্টারদা টেবিলে কাপড় কাটার কাজে ব্যস্ত। নীচে মুখ করে কাপড় কেটে যাচ্ছে। একটু পর মুখ তুলে দেখে, টেবিলের সামনের দিকে বেহায়ার মত দাঁড়িয়ে আছে আব্দুল মাতিন। আব্দুল মাতিন মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করে, ‘মাস্টারদা, কাপড় কাটা আছে তো?’ নিজের কাজ সচল রেখেই মাস্টার বলে, ‘হ্যাঁ, কাটা আছে।’আব্দুল মাতিন আর কোনো কথা না বলে দোকানের ভেতর প্রবেশ করে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct