সরকারের অষ্টম বর্ষপূর্তিতে চেনা সুর, লয় ও ছন্দের পতন যে এভাবে হতে পারে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্ভবত তা ভাবেননি। আচমকাই প্রবল চাপ অনুভব করছেন তিনি। ঘরে ও বাইরে। কালি লেগেছে ভাবমূর্তিতে। প্রশ্ন জেগেছে তাঁর সদিচ্ছাকে ঘিরে। অবস্থা সামাল দেওয়া কাজটা অসম্ভব নয়, কারণ দল ও সরকারে তাঁর কথাই শেষ কথা। এখন যা যা ঘটে গেল, চরিত্রগতভাবে তা আলাদা হলেও এক নিবিড় যোগসূত্র অস্বীকার করা যায় না। এ নিয়ে লিখেছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ শেষ কিস্তি।
হিন্দুত্বের নামে আট বছর ধরে যা যা হয়ে আসছে, প্রতিটির লক্ষ্য মুসলমান সমাজ। পশ্চিমা গণতন্ত্রের চোখে বছরের পর বছর ভারত তাই সমালোচিত। ‘ফ্রিডম হাউস’, ‘ভি ডেম ইনস্টিটিউট’, ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’, জাতিসংঘ অথবা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনকে ভারত ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’, ‘অসত্য’, ‘অজ্ঞ’, ‘সত্যের অপলাপ’ বলে অভিহিত করেছে। বলেছে, ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ওসব হলো পশ্চিমের অনধিকারচর্চা। এই প্রথম ইসলামি দেশের সম্মিলিত কড়া সমালোচনায় কুঁকড়ে যেতে ভারত বাধ্য হলো শাসকদলীয় নেতারা ‘লক্ষ্মণরেখা’ অতিক্রম করে অতি মাত্রায় সাহসী হয়ে মহানবী সা.–কে অসম্মান করার মতো অবস্থানে পৌঁছে গেছেন বলে। নূপুর-নবীনরা যা বলেছেন, তা ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে এড়ানো অসম্ভব। ভর্ৎসিত ভারতকে তাই সতর্ক হতে হয়েছে। মুসলিম দুনিয়ার এই কিল খেতে ভারতের নিশ্চয় ভালো লাগেনি; বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কৃতিত্বে পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক মসৃণ হওয়ার সময়। কিন্তু কিল হজম করতে হচ্ছে। না করে উপায়ও নেই। উপসাগরীয় অঞ্চলে বাস ৮৯ লাখ ভারতীয়র। বিশ্বব্যাংক জানাচ্ছে, ২০২০ সালে তাঁরা সম্মিলিতভাবে ভারতে পাঠিয়েছেন ৮৩ বিলিয়ন ডলার। সমগ্র আরব দুনিয়া নির্ভরশীল ভারতীয় পণ্যের ওপর। অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শকাতর মন্তব্য সম্পর্কহানির কারণ হলে কূটনীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ও অবশ্যম্ভাবী। রাজনীতিকদের অপকর্মের দায় অতএব সামলাতে হচ্ছে কূটনীতিকদের।
কাশ্মীর যতই ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ সমস্যা’ হোক, তার আন্তর্জাতিকীকরণ ঠেকানো যায়নি। উপত্যকার সব রাজনৈতিক দলের বদ্ধমূল ধারণা, সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজের পর নির্বাচন কেন্দ্রের পুনর্বিন্যাস ও জনবিন্যাসে বদল ঘটিয়ে সরকার চাইছে মুসলমানপ্রধান কাশ্মীরে জম্মু ও হিন্দুপ্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে। জম্মু-কাশ্মীরের ইতিহাসে এখনো কোনো হিন্দু মুখ্যমন্ত্রী হননি। কেন্দ্রীয় এ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে উপত্যকার রাজনৈতিক দলগুলো অনেক দিন ধরেই সরব। মহানবী (সা.)–কে নিয়ে বিতর্কের পর মুসলিম দুনিয়ার নজর কাশ্মীরের দিকে নতুন করে পড়ে কি না, তা কৌতূহল সৃষ্টি করবে। ভারতের সতর্ক ও সজাগ না হয়ে উপায় নেই। নূপুর-নবীন তিরস্কৃত ও বহিষ্কৃত, কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে অনেকে তাঁদের পাশে কোমর কষে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের শাস্তির বিরুদ্ধে সরব উগ্র হিন্দুত্ববাদী সমাজ। সমালোচিত হচ্ছে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। ছাড় পাচ্ছেন না প্রধানমন্ত্রীও। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, মুসলমানবিদ্বেষের যে বীজ তিন দশক আগে বপন করা হয়েছিল, ক্রমে তা বিষবৃক্ষে রূপ নিয়েছে। বাঘের পিঠের সওয়ারি হওয়া কঠিন। কিন্তু আরও কঠিন বাঘের পিঠ থেকে নামা। নরেন্দ্র মোদি কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সবার উন্নয়নের মধ্য দিয়ে সবার বিশ্বাস অর্জন তাঁর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
(সমাপ্ত...) সৌজন্যে: প্র. আ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct