সরকারের অষ্টম বর্ষপূর্তিতে চেনা সুর, লয় ও ছন্দের পতন যে এভাবে হতে পারে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্ভবত তা ভাবেননি। আচমকাই প্রবল চাপ অনুভব করছেন তিনি। ঘরে ও বাইরে। কালি লেগেছে ভাবমূর্তিতে। প্রশ্ন জেগেছে তাঁর সদিচ্ছাকে ঘিরে। অবস্থা সামাল দেওয়া কাজটা অসম্ভব নয়, কারণ দল ও সরকারে তাঁর কথাই শেষ কথা। এখন যা যা ঘটে গেল, চরিত্রগতভাবে তা আলাদা হলেও এক নিবিড় যোগসূত্র অস্বীকার করা যায় না। এ নিয়ে লিখেছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ প্রথম কিস্তি।
সরকারের অষ্টম বর্ষপূর্তিতে চেনা সুর, লয় ও ছন্দের পতন যে এভাবে হতে পারে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্ভবত তা ভাবেননি। আচমকাই প্রবল চাপ অনুভব করছেন তিনি। ঘরে ও বাইরে। কালি লেগেছে ভাবমূর্তিতে। প্রশ্ন জেগেছে তাঁর সদিচ্ছাকে ঘিরে। অবস্থা সামাল দিতে তিনি তৎপর। কাজটা অসম্ভব নয়, কারণ দল ও সরকারে তাঁর কর্তৃত্বের রাশ এখনো দৃঢ়। এক পক্ষকাল ধরে যা যা ঘটে গেল, চরিত্রগতভাবে তা আলাদা হলেও এক নিবিড় যোগসূত্র অস্বীকার করা যায় না। প্রথম চাপ সৃষ্টিকারীরা কাশ্মীরি পণ্ডিত, এতগুলো দশক ধরে যে জনগোষ্ঠী ছিলেন ভূস্বর্গের রাজনীতিতে বিজেপির প্রধান আশ্রয়; একের পর এক ‘বাছাই হত্যা’ তাঁদের এতটা অসহায় করে তুলেছে যে সরকারি ভরসায় আস্থা না রেখে তাঁরা উপত্যকা ছেড়ে জম্মু যাওয়ার জোরালো দাবি তুলেছেন। চলেও গেছে কয়েক শ পরিবার। কাশ্মীরি পণ্ডিতেরা নরেন্দ্র মোদির সরকারের কাছে হঠাৎই হয়ে উঠেছেন ‘শাঁখের করাত’। তাঁদের দাবি মানলে প্রমাণিত হবে, মোদির কাশ্মীর নীতিও ব্যর্থ। তিনিও পূর্বজদের মতো পণ্ডিত-স্বার্থ রক্ষা করতে পারলেন না। দাবি না মানলে প্রচারিত হবে, জঙ্গিদের বন্দুকের কাছে সরকার পণ্ডিতদের জিম্মি করে রেখেছে। ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজ সত্ত্বেও কাশ্মীর যে তিমিরে ছিল, সেখানেই রয়ে গেছে। ঘরের অভ্যন্তরের এই সসেমিরা অবস্থার মাঝে আচমকাই সৃষ্ট অনাকাঙ্ক্ষিত দ্বিতীয় সংকট, যে জন্য মোদি সরকার মোটেই প্রস্তুত ছিল না।
সে-ও প্রায় ১০ দিন আগের ঘটনা। কাশী-মথুরাকে ‘শৃঙ্খলমুক্ত’ করার প্রচেষ্টা নতুন করে যখন গতি পাচ্ছে, সেই সময়, গত মাসের শেষাশেষি এক সর্বভারতীয় নিউজ চ্যানেলে বিতর্ক সভায় বসে বিজেপির রাষ্ট্রীয় মুখপাত্র নূপুর শর্মা মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে নিয়ে অবমাননাকর কিছু মন্তব্য করেন। এর দুই দিনের মধ্যে একই ধরনের মন্তব্য টুইট করেন বিজেপির দিল্লি শাখার মিডিয়া ইনচার্জ নবীন জিন্দল। তত দিনে এ মন্তব্য নিয়ে শুরু হয়ে গেছে বিক্ষিপ্ত গোলমাল। উত্তরপ্রদেশের কানপুরে দাঙ্গা বেধেছে। মুম্বাই পুলিশের কাছে দায়ের হয়েছে নূপুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ। এক সপ্তাহ কেটে গেলেও বিজেপি নেতারা কেউ তখনো নূপুর-নবীনকে ভর্ৎসনা করেননি। সরকার বা পুলিশ প্রশাসনে হেলদোলও দেখা যায়নি। টনক নড়ে গত রোববার, উপরাষ্ট্রপতি ভেঙ্কাইয়া নাইডুর সফর চলাকালে যখন কাতার ডেকে পাঠায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে এবং তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, অবিলম্বে বিশ্বের মুসলমানদের কাছে ভারতকে ক্ষমা চাইতে হবে। কাতারের সুরে সুর মেলায় উপসাগরীয় অঞ্চলের অন্যান্য দেশও। আসতে থাকে একের পর এক নিন্দাজনক প্রস্তাব। হাঁক দেওয়া হয় ভারতীয় পণ্য বর্জনের। কাতারের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত জানান, দলের এলেবেলে নেতারা ওই মন্তব্য করেছেন, যা ভারত সরকারের মনোভাব নয়। সময় নষ্ট না করে বিজেপি নূপুরকে বরখাস্ত করে, নবীনকে বহিষ্কার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ভারত সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কারও প্রতি কোনো বিদ্বেষ নেই।
এই প্রথম বোঝা গেল শাসক দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির আবর্তে দেশের সরকার কীভাবে জড়িয়ে পড়েছে। নূপুর-নবীনদের কটূক্তি যদিও মোটেই বিনা মেঘে বজ্রপাত নয়; নিরঙ্কুশ ক্ষমতালাভের পর থেকে বিজেপির শীর্ষ নেতাদের প্রশ্রয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রসার যেভাবে ঘটে চলেছে, অহরহ ঘৃণা উদ্গিরণ হয়েছে, অপরাধীদের আড়াল করতে দল ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে, রাজ্যে রাজ্যে নূপুর-নবীনদের তা সাহসী ও বেপরোয়া করে তুলেছে। অযোধ্যা মামলা জেতার পর গো–রক্ষার নামে বাড়াবাড়ির চরিত্র কেমন, তা গোপন নয়। গোপন নেই গণপিটুনির সংখ্যাও। নিছক সন্দেহের বশে নিহত হয়েছেন নিরপরাধ মানুষ। এসেছে ধর্মান্তর রোধ আইন। ছড়িয়েছে লাভ জিহাদ। তাণ্ডব চালিয়েছে রোমিও পুলিশ। অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রথম ধাপ হিসেবে কার্যকর হয়েছে তিন তালাক নিষিদ্ধ আইন। হিন্দুধর্ম সংসদ থেকে খোলামেলা হাঁক দেওয়া হয়েছে মুসলমান গণহত্যার। শুরু হয়েছে আমিষ বন্ধের অভিযান। জমেছে দেশদ্রোহ মামলার পাহাড়। শুরু হয়েছে মসজিদে মসজিদে ‘শিবলিঙ্গ’ খুঁজে উপাসনালয়ের চরিত্র বদলের উদ্যোগ। আইন অবজ্ঞা করে হিন্দুত্বের নামে যথেচ্ছাচারিতায় পার পাওয়া গেলে নূপুর-নবীনেরা অত্যুৎসাহী তো হবেনই! এটাই তো একমাত্র পরিণতি!
সৌজন্যে: প্র. আ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct