তেজস্ক্রিয়তা হলে সেই প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একটি অস্থিতিশীল পরমাণুর নিউক্লিয়াস আয়নাইজিং বিকিরণে আলফা কণা, বিটা কণিকা, গামা রশ্মি নির্গত করে শক্তি হারায়। যেসব মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা ৮২-এর বেশি, তাদের নিউক্লিয়াস দ্রুত গতির নিউট্রন দ্বারা আঘাত করলে নিউক্লিয়াস থেকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে উচ্চভেদন সম্পূর্ণ বিকিরণ নির্গত হয় যা তেজস্ক্রিয় বিকিরণ। ফরাসি বিজ্ঞানী হেনরি বেকেরেল ১৮৯৬ সালে তা আবিষ্কার করেন। এ নিয়ে লিখেছেন আরাফাত রহমান। আজ শেষ কিস্তি।
তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহারের পরিধি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। যেমন: ক্যানসার রোগ নিরাময়ের কাজে, উন্নত বীজ তৈরির গবেষণায়, খনিজ পদার্থে বিভিন্ন ধাতুর পরিমাণ নির্ণয়ে উক্ত ধাতুর তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ তেজস্ক্রিয় প্রদর্শক হিসেবে, ঘড়ির কাঁটায় তেজস্ক্রিয় থোরিয়ামের সঙ্গে জিঙ্ক সালফাইড মিশিয়ে ঘড়ির কাঁটা ও নম্বরে প্রলেপ দেওয়া হয়। ফলে এরা অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে, তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ থেকে ফিশন প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত তাপ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে টারবাইন ও জেনারেটরের মাধ্যমে বিদু্যত্ উৎপাদনে, নির্মাণ বা উৎপাদন-শিল্পে কাগজ, প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি বিভিন্ন বস্তুর পুরুত্ব, ঘনত্ব ও উপাদানের সঠিক পরিমাণ নির্ণয়ে এবং কার্বন ডেটিং পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করে জীবাশ্মসংক্রান্ত নমুনা ও শিলাখণ্ডের বয়স নির্ধারণে। ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তেজস্ক্রিয়তায় বিপদও বাড়ছে। এই রশ্মি জীবদেহে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। উচ্চ মাত্রার তেজস্ক্রিয় বিকিরণ মানবদেহে নানা রকম ক্যানসারের জন্ম দিতে পারে। দীর্ঘদিন মাত্রাতিরিক্ত তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সংস্পর্শে থাকলে মানুষের রোগপ্রতিরোধক্ষমতা হ্রাস পায়, মানসিক বিকার এমনকি বিকলাঙ্গতাও দেখা দিতে পারে। এর ক্ষতিকর প্রভাব বংশপরম্পরায়ও পরিলক্ষিত হয়। যেমন: তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে বিকালঙ্গ শিশুর জন্ম হতে পারে। তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থ মানবসভ্যতার জন্য হুমকিস্বরূপ।
তেজস্ক্রিয়তাজনিত দূষণ মানুষের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর এক ধরনের অদৃশ্য দূষণ। তেজস্ক্রিয়তার উত্স সূর্য ও মহাশূন্য, যেখান থেকে তা পৃথিবীতে পৌঁছায়। ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয়তার অধিকাংশ বিকরিত হয় বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে, বিশেষত পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্ফোরণ, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক সামগ্রী থেকে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য লেজার রশ্মি, এক্সরে মেশিন, রঙিন টেলিভিশন সেট, মাইক্রো-ওয়েভ ওভেন ইত্যাদি। তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতিকর প্রভাব ভালোভাবে লক্ষ করা যায় কোষ গঠনের ক্ষেত্রে। তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত কোষ মরে গেলে বা আপনাআপনি সুস্থ হয়ে উঠলে পরবর্তী সময়ে কোনো সমস্যা ঘটে না। কিন্তু একটি ক্ষতিগ্রস্ত কোষ পরবর্তী পর্যায়ে ক্যানসারপ্রবণ হয়ে ওঠে। মানুষের জননকোষ তেজস্ক্রিয়তায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেগুলো বন্ধ্যা হয়ে পড়ে, নবজাতক বিকলাঙ্গ বা মানসিকভাবে অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। কঠিন এবং তরল তেজস্ক্রিয় বর্জ্য সাধারণত গবেষণা, শিল্প, শিক্ষা, কৃষি, চিকিৎসা ইত্যাদি থেকে উত্পন্ন হয়। বিভিন্ন উত্স থেকে উদ্ভূত তেজস্ক্রিয় বর্জে্যর মধ্যে কিছু পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা থাকে এবং এই বর্জ্য যদি যথোপযুক্তভাবে ব্যবস্থাপনা না করা হয়, তাহলে তা মানবদেহ ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করবে। বিভিন্ন প্রকার কঠিন তেজস্ক্রিয় বর্জ্য; যেমন: আয়ন-এক্সচেঞ্জ রেজিন, গ্রাফাইট প্লাগ, ধাতব দ্রব্য, দূষণকৃত ভায়াল, হ্যান্ড গ্লাভস, প্লাস্টিক সিরিঞ্জ, শু-কভার, প্রটেকটিভ ক্লথ, প্লাস্টিক এবং মেটালিক তার ইত্যাদির বিভিন্ন বিকিরণ স্থাপনা থেকে উত্পন্ন হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সার কারখানা, পেপার মিল ইত্যাদি থেকে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য উৎপন্ন হয়।
বিশ্ব জুড়ে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য অপসারণের সমস্যা জনসমাজে গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। তেজস্ক্রিয় বর্জ্য গভীর সমুদ্রে নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে, যা সমুদ্রের চারপাশে বসবাসরতদের জন্য একটি বড় আতঙ্কের বিষয়। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য নিক্ষেপের ঘটনায় দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের উদ্বেগ বাড়ছে। অধুনা পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের ফলে সৃষ্ট দূষণ বিশ্বব্যাপী মানুষের আতঙ্ক ও উদ্বেগের কারণ হয়েছে এবং মানবজাতি ও সামগ্রিকভাবে প্রাণিজগতের নিরাপত্তার স্বার্থে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহারের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। তেজস্ক্রিয়তা প্রতিরোধে কিছু ব্যক্তিগত সচেতনতাও জরুরি। যেমন: প্রখর সূর্যকিরণে বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকা, যতটুকু সম্ভব বৃষ্টির পানি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা, ক্লোরোফিল ও অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করা, খাওয়ায় আয়োডিন ব্যবহার করা, দিনের বেলায় বাইরে বের হলে সানগ্লাস ব্যবহার করা, বিভিন্ন রেডিয়েশন থেরাপি অতিমাত্রায় গ্রহণ না করা, এক্সরে ও রেডিয়েশন হয়— এমন সব মেশিন থেকে দূরে থাকা এবং দিনের বেলায় বাইরে বের হলে শরীর ঢেকে রাখা বা সান-লোশন বা ক্রিম ব্যবহার করা। (সমাপ্ত..)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct