‘জঙ্গলের রসগোল্লা’ কেন্দু
নরসিংহ দাস (সহশিক্ষক, এলাহিয়া হাই মাদ্রাসা)
_________________________________
“এ ডালের মন বাঁদরি, সে ডালে যায়/ ডালে ডালে মন বাঁদরি কেঁদ পাকা খায়...।” কেন্দু ফল নিয়ে জঙ্গলমহলের এই গান এই অঞ্চলের অধিবাসীদের মুখে মুখে ফেরে। আর এই গান থেকে বোঝা যায় পাকা কেন্দু ফল খাওয়ার যোগ্য। ভারতীয় উপমহাদেশের স্থানীয় বৃক্ষ প্রজাতির এই গাছ সাধারণত ল্যাটারাইট মৃত্তিকাযুক্ত ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে লক্ষ্য করা যায়। বিশেষত ক্রান্তীয় জলবায়ুর অন্তর্গত পর্নমোচী বনভূমির শাল, পলাশ, মহুয়া গাছের সঙ্গে এই গাছের অবস্থান। এই গাছের ফল ও পাতা গুনাগুন সমৃদ্ধ। গোলাকার ও সুস্বাদু হওয়ায় কারনে কেন্দু ফলকে ‘জঙ্গলের রসগোল্লা’ নামে অভিহিত করা হয়।
বিজ্ঞানসম্মত নাম:
ডায়োস্পাইরোস মেলানোক্সন রক্সব পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, Ebenaceae, যা ভারতীয় উপমহাদেশের স্থানীয়।
স্থানীয় নাম:
স্থানীয় ভাবে এটি তেম্বুরিনী নামে পরিচিত। কোথাও কোথাও টেন্ডু, কেন্দ্, কেঁদ বা কেন্ড নামেও এই ফলকে বোঝায়। বাস্তবে অঞ্চল বিশেষে আঞ্চলিক ভাষার উপর নির্ভর করে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে নানান নাম।
ভৌগোলিক অবস্থান:
পূর্ব-মধ্য ভারতের ল্যাটেরাইট মৃত্তিকাযুক্ত ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চলে এই গাছের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। শাল পলাশের মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন ভাবে অবস্থান করে এই গাছ। পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম বর্ধমান ও বীরভূম জেলার পশ্চিম অংশে এই গাছ লক্ষ্য করা যায়।
প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য:
এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় ফল যা অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং ফাইবার সমৃদ্ধ। এই ফলে প্রচুর পরিমানে শর্করা, প্রোটিন, ফাইবার এবং ভিটামিন সি সমৃদ্ধ বি-ক্যারোটিন, টের্পেনয়েডস, স্যাপোনিন এবং ট্যানিন থাকে । কেন্দু পাতা দিয়ে বিড়ি তৈরী হয়। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এই পাতা এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পাতা জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে এই অঞ্চলের অধিবাসী জীবিকা নির্বাহ করে। কেন্দু ফলের গুনাগুন ও পাতার অর্থনৈতিক গুরুত্ব থাকায় বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে বাগান তৈরি করে এই গাছ লাগানো হয়েছে।
কেন্দু চাষ:
ক্রান্তীয় জলবায়ুর ল্যাটেরাইট সমৃদ্ধ মৃত্তিকায় প্রাকৃতিকভাবে এই গাছের জন্ম। তবে বাগান তৈরি করে চাষ করতে গেলে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো নজর দেওয়া জরুরি।
মাটি:
ল্যাটেরাইট এবং কালো মাটি এই গাছের বৃদ্ধির জন্য উপযোগী। এছাড়াও, বনাঞ্চলের মাটি এই গাছের জন্য ফলদায়ক। বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের জন্য অধিক জল ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন হিউমাস সমৃদ্ধ মাটি প্রয়োজন। কোয়ার্টজাইট, শেল এবং বেলেপাথর সহ পাথুরে মাটিতেও এই গাছ বেড়ে ওঠে ভালোভাবে।
উষ্ণতা ও বৃষ্টিপাত:
শীতল শুষ্ক এবং উষ্ণ আর্দ্র জলবায়ু এই গাছের জন্য আদর্শ। সাধারণত ৯০০ মিটার উচ্চতার মধ্যে এই গাছ জন্মায়। বার্ষিক বৃষ্টিপাত ৫০-১৫০ সেমি এবং তাপমাত্রা ৮-৪৮° সেন্টিগ্রেড এই গাছের বৃদ্ধির জন্য উত্তম। উচ্চ তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা ফল পরিপক্ক হওয়ার জন্য প্রয়োজন।
বীজ শোধন:
ঠান্ডা জলে প্রায় ১২ ঘন্টা বীজ ভিজিয়ে রাখলে অঙ্কুরোদগম হয়। স্টাম্প পদ্ধতিতে বীজ রোপণ করলে এই গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। গ্রাফটিং পদ্ধতি দ্বারা উদ্ভিদের বৃদ্ধি সম্ভব। ৫:৩:২ অনুপাতের FYM, মাটি এবং বালির মিশ্রণ পলিথিন ব্যাগে দিয়ে বীজের অঙ্কুরোদগম করা যেতে পারে। জানুয়ারি-মার্চ মাস গ্রাফটিং এর আদর্শ সময়।
রোপন পদ্ধতি:
কেন্দু হলো একটি মাঝারি আকারের গাছ বা গাছের গুল্ম যা প্রাকৃতিক অবস্থায় বনভূমিতে বা অবনমিত জমিতে পাওয়া যায়। ভাল ধরণের মাটিতে যেমন বেলে দোআঁশ মাটিতে গাছের বৃদ্ধি হয় ভালোভাবে। মাটি ও জলবায়ুর ধরণ অনুসারে উদ্ভিদের মধ্যে ব্যাবধান ঠিক করা হয়। যেখানে পাথুরে মাটি বা ল্যাটেরাইট মাটি রয়েছে সেখানে গাছগুলি ৬ মিটার দূরত্বে রোপন করতে হবে। গাঙ্গেয় সমভূমিতে গাছের ব্যাবধান থাকবে ৮-১০ মিটার দূরত্বে। জুলাই-আগস্ট মাসে এই গাছ রোপণ করা হয়। বর্গাকার পদ্ধতিতে রোপন করাই উত্তম।
ছাঁটাই:
চারাগুলি সাধারণত ২ মিটার / ২ মিটার দূরত্বে রোপণ করা যেতে পারে। অধিক পরিমানে ছাঁটাই গাছগুলির দ্রুত বৃদ্ধি ঘটাবে। অতিরিক্ত শাখা ও আগাছা ছেঁটে ফেলতে হবে। গাছগুলি সাধারণত ৬০-৯০ সেন্টিমিটার উচ্চতায় কাটা হয়, যাতে গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটতে পারে। কিছু অবাঞ্ছিত গাছও কেন্দু চারা বৃদ্ধির সাথে বাড়তে থাকে। আগাছা নিয়ন্ত্রণের জন্য লাঙ্গল চালিয়ে জমি পরিষ্কার রাখতে হবে।
মালচিং:
এই পদ্ধতি আগাছা নিয়ন্ত্রণ করে এবং মাটির আর্দ্রতাকে গাছের বৃদ্ধির জন্য বজায় রাখে। মালচিং করার সামগ্রী হলো - ধানের খড়, কাঠের গুঁড়া, শুকনো কলা পাতা, পলিথিন ইত্যাদি। কালো পলিথিন আগাছা নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে উপযুক্ত। জৈব মালচিং মাটির গুণমান উন্নত করার পাশাপাশি আগাছা নিয়ন্ত্রণ এবং মাটির জৈবিক ক্রিয়াকলাপ উন্নত করে।
রোগ দমন:
গাছের পুরোনো পাতা বেশি রোগাসক্ত হয়ে থাকে। প্রয়োজনীয় ছত্রাকনাশক বা মানকোজেব দ্বারা এই রোগ নিরাময় সম্ভব। এছাড়াও, জৈব পদ্ধতিতে নিমতেল ব্যবহার করে এই গাছের রোগ নিরাময় করা যায়। অনেক ধরণের পোকা-মাকড়, মাছির আক্রমণও দেখা যায় এই গাছে। বর্তমানে এই ফলের অধিক চাহিদা রয়েছে। বিশেষত মালভূমি অঞ্চলের হাট বাজার এলাকায় গ্রীষ্মকালীন ফল হিসেবে বিক্রি করা হয়। কোথাও ওজন দরে আবার কোথাও পিস হিসেবে বিক্রি করা হয়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct