পৃথিবীর অন্যতম জীব বৈচিত্রের আধার বা আঁতুড়ঘর হল সুন্দরবন। এটি বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, যা প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। সুন্দরবন যেমন পরিবেশগত দুর্যোগের হাত থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকাকে রক্ষা করে চলেছে, তেমনি জলবায়ুগত ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রেও এই বনাঞ্চলের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। সুন্দরবনে হরেক রকম প্রজাতির ম্যানগ্রোভ গাছ জন্মায় ও বংশ বিস্তার করে। ৫জুন আন্তর্জাতিক পরিবেশ দিবস উপলক্ষে লিখেছেন সজল মজুমদার।
মি পৃথিবীর অন্যতম জীব বৈচিত্রের আধার বা আঁতুড়ঘর হল সুন্দরবন। এটি বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, যা প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। সুন্দরবন যেমন পরিবেশগত দুর্যোগের হাত থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকাকে রক্ষা করে চলেছে, তেমনি জলবায়ুগত ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রেও এই বনাঞ্চলের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। সুন্দরবনে হরেক রকম প্রজাতির ম্যানগ্রোভ গাছ জন্মায় ও বংশ বিস্তার করে। সাধারণত লবণাক্ত ও কর্দমাক্ত জাতীয় অনুকূল পরিবেশেই এই গাছ গুলো জন্মে থাকে আমরা জেনে আসছি। কিন্তু এসব প্রজাতির মধ্যে এক ধরনের ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ রয়েছে যা কিনা নদীর চর যেখানে নোনা এবং মিষ্টি জলের মিশ্র জোয়ার-ভাটা খেলে সেখানে জন্মায়। আজ্ঞে হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি। অবশ্য লবণের পরিমাণ ১০ পি পি টির বেশি হলে এরা বেঁচে থাকতে পারেনা। বিশেষ প্রজাতির এই ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের নাম চাক কেওড়া। যার বিজ্ঞানসম্মত নাম Sonneratia Caseolaris । এর আদি নিবাস সুন্দরবন হলেও গঙ্গাতীর বরাবর পানিহাটি, কোন্নগর, উলুবেড়িয়া, উত্তরপাড়া তেও বিস্তার হয়েছে এই গাছের। তবে সাগরদ্বীপের দিকে যত এগোনো যাবে,এই গাছের ঘনত্ব তত বেশি। গবেষকদের দাবি, গত কুড়ি বছরে ধীরে ধীরে সুন্দরবনের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিস্তার লাভ করেছে এই গাছ। গবেষকরা এও বলেছেন প্রাকৃতিক নিয়মেই বংশ বাড়াচ্ছে এই গাছ। কিন্তু মূলত গঙ্গা পাড়ে দূষণের পরিমাণ অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় এই গাছের বংশবিস্তার আশানুরূপ হচ্ছে না। হুগলি নদীতে লবণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার দরুন এবং জলে COD বা কেমিকাল অক্সিজেন ডিমান্ড (৬২.২৩ - ১১২.৮৭ mg/L) অত্যধিক বেড়ে যাওয়ার ফলে চাক কেওড়া জাতীয় এই ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ টির উজানের দিকে প্রাচুর্যতার সহিত বৃদ্ধি ঘটছে। বাংলার চৈত্র মাসে এই গাছে ফুল আসে। ফল পরিণত হয় জ্যৈষ্ঠ মাসের দিকে। ফলের আকার ও ধরনের জন্য এই গাছটির ফল ম্যানগ্রোভ আপেল নামেও পরিচিত। চাক কেওড়া ফলের চাটনির স্বাদ নাকি অসাধারণ হয়। সম্প্রতি মেরিন পলিউশন বুলেটিন নামক একটি গবেষণাপত্রে একদল নবীন গবেষকদের গবেষণায় নোনা ও মিষ্টি জলের সংমিশ্রণে বেড়ে ওঠা এই বিশেষ প্রজাতির ম্যানগ্রোভের বংশবিস্তারের বিষয়টি উঠে এসেছে। প্রসঙ্গত ২০২২ সালের এবারের UNEP আয়োজিত বিশ্ব পরিবেশ দিবসের এবারের স্লোগান হলো ‘Only One Earth’ ।
অর্থাৎ এক এবং একমাত্র ভু বিশ্বের সামগ্রিক ভারসাম্য সঠিক রাখতে হলে বৃক্ষরোপণ তো করতেই হবে, তথাপি চাক কেওড়া জাতীয় এই ধরনের পরিবেশ বান্ধব ও উপকারী ম্যানগ্রোভ লাগানো বিশেষ জরুরী ও কার্যকরী। আর এই উদ্দেশ্য কেই সামনে রেখে আজ বরাহনগর হুগলি নদীর পাড়ে বিশেষ প্রজাতির ২০০টি ম্যানগ্রোভ রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মুখ্যত পূর্বাশা ইকো হেলপ্লাইন সোসাইটি, ম্যানগ্রোভ থিয়েটার সেন্টার, ইস্টুরাইন এবং কোস্টাল স্টাডিজ ফাউন্ডেশন, ভু সংকল্প, বরাহ নগর ইউনাইটেড অ্যাসোসিয়েশন, প্রাণ কৃষ্ণ সাহা লেন ফিশারম্যান অ্যাসোসিয়েশন প্রমুখ পরিবেশবাদী ও সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্রিক সংগঠনগুলির যৌথ অভিনব পরীক্ষামূলক প্রয়াস এটি হতে চলেছে। মহৎ এই কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকবেন বিশ্বভারতীর প্রাক্তন অধ্যাপক ড: মলয় মুখোপাধ্যায়, খারী বিজ্ঞানী ড: সৌরভ পাল, গবেষক কানাইলাল দাস , নাট্যব্যক্তিত্ব সজল মন্ডল সহ বিশিষ্টজনেরা। এই উদ্যোগ প্রসঙ্গে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্য বনপাল ড: প্রনবেশ সান্যাল বলেন “ হুগলি নদীর জলের লবণাক্ততা একটু একটু করে বাড়ছে, কারণ সমুদ্রতল উঁচু হওয়ার ফলে হুগলি নদীতে জোয়ারের জল আসছে, তাতে নদীর জলের লবণাক্ততা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ফলে অত্যধিক দূষণযুক্ত জায়গায় চাক কেওড়া জাতীয় ম্যানগ্রোভ স্বাভাবিকভাবে হওয়ার ফলে সেখানকার কার্বন শোষণ করছে, এবং অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করছে। গঙ্গার জল দূষণের পরিমাণ কমাতে চাক কেওড়া বিশেষ উপযোগী ।তথাপি জলে মাছের বংশ বিস্তার করতে এই গাছের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ চাক কেওড়ার পাতায় এক ধরনের গ্রোথ প্রমোটিং হরমোন রয়েছে, যা মাছের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এছাড়া এই গাছের ফল সুস্বাদু, পেটের পক্ষেও স্বাস্থ্যকর। পাশাপাশি উচুঁ নদীপারের ধস আটকাতেও এই গাছের বিশেষ কার্যকারিতা রয়েছে” । অন্যদিকে সুন্দরবনের ভূমিপুত্র ম্যানগ্রোভ ম্যান উমাশঙ্কর মন্ডল এ প্রসঙ্গে বলেন “ আমরা দীর্ঘদিন সুন্দরবনে ম্যানগ্রোভ রোপনের কাজে যুক্ত রয়েছি, তবে পরীক্ষামুলকভাবে হুগলি নদীর পাড়ে চাক কেওড়া জাতীয় ম্যানগ্রোভ রোপনের প্রচেষ্টা প্রথম শুরু করতে চলেছি। মূলত নোনা ও মিষ্টি জলের সংমিশ্রণ যুক্ত এলাকায় এই জাতীয় ম্যানগ্রোভের প্রাধান্য রয়েছে, তথাপি সে কারণেই আমরা বিভিন্ন সমাজসেবা মূলক ও পরিবেশ কেন্দ্রিক সংস্থা একত্রিত হয়ে এই কাজটি শুরু করতে চলেছি। এই উদ্যোগ সফলতা পেলে হুগলি নদীর দুই পাড়ের মানুষ ভীষণ ভাবে উপকৃত হবেন। কারণ এই জাতীয় ম্যানগ্রোভ কার্বন শোষণ করে, জল শোধন করে, মাছের বংশ বিস্তার ঘটায়, এবং নদী পারে র ভাঙ্গন রোধ করতে সাহায্য করে। ম্যানগ্রোভ রোপনের এই প্রক্রিয়া আগামী কয়েকবছর স্থানভেদে এভাবেই চলতে থাকবে”।
লেখক শিক্ষক ও বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct