মিত্রদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যুদ্ধপ্রিয় হয়ে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেনকে ৮০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সামরিক সহায়তা দিয়েছেন। এরপরই গত সোমবার তাঁর প্রশাসন জানায় যে তারা ইউক্রেনকে এমন কোনো ক্ষেপণাস্ত্র পাঠাবে না, যা রাশিয়ার ভেতরে আঘাত হানতে পারে। এর আগে রাশিয়া সতর্ক করে দিয়েছিল যে ইউক্রেনকে এ রকম অস্ত্র দিলে তা হবে রেডলাইন অতিক্রম করা। বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছেন ড্যানিয়েল উইলিয়ামস।
মিত্রদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যুদ্ধপ্রিয় হয়ে উঠেছে মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেনকে ৮০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সামরিক সহায়তা দিয়েছেন। এরপরই গত সোমবার তাঁর প্রশাসন জানায় যে তারা ইউক্রেনকে এমন কোনো ক্ষেপণাস্ত্র পাঠাবে না, যা রাশিয়ার ভেতরে আঘাত হানতে পারে। এর আগে রাশিয়া সতর্ক করে দিয়েছিল যে ইউক্রেনকে এ রকম অস্ত্র দিলে তা হবে রেডলাইন অতিক্রম করা। অবশ্য এর দুই দিন পর গত বুধবার ইউক্রেনের বাইরে আঘাত করা যাবে না—এই শর্তে দূরপাল্লার রকেট সিস্টেম দিতে রাজি হন বাইডেন। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিধাগ্রস্ততা স্পষ্ট। সম্ভবত অর্থনৈতিক কারণে এমনটা ঘটছে। যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতির একটা কারণ। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিধি-নিষেধের কারণে মার্কিন সরকারের তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন কম হচ্ছে। এর সঙ্গে সারের ঘাটতি, গম ও ভুট্টার ফলন হুমকির মুখে পড়েছে। কারণ রাশিয়া ও ইউক্রেনেই মূলত বেশি সার উৎপাদিত হয়। অন্যদিকে ইতালির প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘি গত সপ্তাহে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ফোন করে প্রস্তাব দেন যে মস্কো যদি ইউক্রেনের অবরুদ্ধ বন্দরগুলো থেকে গম সরবরাহ করতে দেয়, তাহলে ইউক্রেন আগ্রাসনের কারণে রাশিয়ার ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে পারে ইউরোপ।
এর দুই দিন পর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ইউক্রেনকে দূরপাল্লার উন্নত অস্ত্রসহ আরো সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের জন্য মিত্রদের প্রতি আহ্বান জানান। এ সময় তিনি পুতিনকে অকথ্য ভাষায় আক্রমণ করেন। এরপর ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ ও জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ পুতিনকে ফোন করে রুশ সেনাদের যুদ্ধ বন্ধ, ইউক্রেন ত্যাগ, গম বের হতে দেওয়া এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু করার দাবি জানান। কিন্তু ম্যাখোঁ ও শোলজ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথা উল্লেখ করেননি। ফলে একটা বিষয় স্পষ্ট যে ইউক্রেন প্রশ্নে পশ্চিমারা বিভক্ত।ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই যুদ্ধ দরিদ্র দেশগুলোতে ক্ষুধা এবং ধনীদের মন্দার কারণ হতে পারে বলে সতর্ক করা হচ্ছে। পাশ্চাত্যের জন্য প্রশ্ন হচ্ছে, হয় ইউক্রেনকে সাহায্য করা সেটা যেভাবেই হোক না কেন অথবা সবার জন্য ক্ষতি কমানোর ও লড়াই বন্ধ করার উপায় খুঁজে বের করা। একদিক দিয়ে রোম, প্যারিস, বন ও লন্ডন থেকে গত সপ্তাহের মিশ্র বার্তায় বিভক্তি দেখা দিলেও গম ইস্যুটি সবারই মূল উদ্বেগের কেন্দ্রে স্থান পেয়েছে। অর্থনৈতিক অস্বস্তির ভয়ে কিছু ইউরোপীয় কম্পানি রাশিয়াার দাবি অনুযায়ী রুবলে প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য পরিশোধের কৌশলী উপায় খুঁজে নিয়েছে। এর মধ্যে জার্মানি, স্লোভেনিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, স্লোভাকিয়া, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও ফ্রান্সের সংস্থাগুলো রয়েছে। এ ছাড়া নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন-ন্যাটোর একমাত্র কর্তৃত্ববাদী সদস্য রাষ্ট্র তুরস্ক বলেছে, তারা ন্যাটোতে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের প্রবেশের ক্ষেত্রে ভেটো দিতে চায়। হাঙ্গেরির নেতা ভিক্টর অরবান রাশিয়ার ওপর আদৌ কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চান না।
যা কিছুই ঘটুক, জেলেনস্কি উপলব্ধি করতে পারছেন যে তিনি নড়বড়ে হয়ে পড়েছেন। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভীতশ্রদ্ধ এবং তিনি চান যে ইইউ রাশিয়াকে পরাজিত করার দিকে নজর রাখুক, আরো অস্ত্র পাঠাক। এটা অনুমান করা কঠিন যে ইউরোপীয় দুর্দশা ও অনৈক্যের এই লক্ষণগুলোতে পুতিন কতটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। রাশিয়ারও নিজস্ব কিছু সমস্যা রয়েছে। রুশ মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৮ শতাংশ এবং ভোক্তাদের ব্যয় চলতি বছর ১৩ শতাংশ এবং ২০২৩ সালে ২২ শতাংশ হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ব্যাংক মরগান স্ট্যানলি এ তথ্য জানিয়েছে। এর পরও পুতিনকে অবিচলিত মনে হচ্ছে। ম্যাখোঁ ও শোলজের সঙ্গে তাঁর আলোচনার পর ক্রেমলিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার নয়, বরং ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহের বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে। এতে অস্থিতিশীলতার জন্য ইউক্রেনে পশ্চিমা অস্ত্র সরবরাহকে দায়ী করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, ইউক্রেনের অর্থনীতি ৪৫ শতাংশ সংকুচিত হবে। দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধের ফলে বিজয় অর্জিত হলেও ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে তা পরাজয়ের নামান্তর হবে। কিয়েভ স্কুল অব ইকোনমিকসের মতে, সরকারি ও বেসরকারি অবকাঠামোর ক্ষতি এরই মধ্যে ৬০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই যুদ্ধের বৈশ্বিক প্রভাবও ভয়াবহ। মার্কেট ওয়াচের মতে, ইউক্রেন যদি রাশিয়াকে তার ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করতে সফল হয়, এর পরও এক বছরের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতি বিধ্বংসী হতে পারে। যেসব দেশ ইউক্রেন থেকে গম আমদানি করে থাকে, সেসব দেশে এরই মধ্যে খাদ্যঘাটতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আর জ্বালানি নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে ইউরোপ একটি অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মার্কেট ওয়াচের মতে, অর্থনৈতিক ক্ষতি শুধু ইউক্রেনের জন্য নয়, বরং বাকি বিশ্বের জন্যও মারাত্মক হবে। তাই যুদ্ধের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা না করে নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই জরুরি ভিত্তিতে বৈশ্বিক খাদ্যসংকট, উন্নয়নশীল বিশ্বে ক্রমবর্ধমান ঋণ সংকটের আশঙ্কা এবং পাশ্চাত্যে মন্দার হুমকি মোকাবেলার উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct