নিজস্ব প্রতিবেদক, কলকাতা, আপনজন: প্রতি বছরের মতো এবছরও রাজ্যের শীর্ষ সংখ্যালঘু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আল আমীন মিশনের পড়ুয়ারা মাধ্যমিকে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখল। প্রথম দশে স্থান করে নিল দুজন ছাত্রী আফরিন খাতুন ও মোনালিসা পারভিন।এ বছর মাধ্যমিকে সংখ্যালঘু মেয়েরা দারুণ ফল করেছে। ব্যতিক্রম হয়নি আল আমীন মিশন। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে তুলে আনা দরিদ্র মেধাবীদের একত্র করে যথাযোগ্য শিক্ষাদানে তাদেরকে সাফল্যের পথ দেখাচ্ছে আল আমীন মিশন।সাড়ে তিন দশকের আল-আমীন মিশনে প্রত্যকে বছর ফল প্রকাশের দিন উৎসবের মেজাজ থাকে। কিন্তু অতীতের বহু বছরের পরিসংখ্যানকে পেছনে ফেলে এবছর মিশনের মুকুটে গৌরবের নতুন অধ্যায় সংযোজিত হয়েছে।আল আমীন মিশনের সম্পাদক এম নুরুল ইসলাম জানিয়েছেন, এ বছর হাওড়ার খলতপুরের মূল ক্যাম্পাস সহ আল আমীন মিশনের অন্যান্য ক্যাম্পাস মিলিয়ে পড়ুয়াদের মধ্যে মাধ্যমিকে ৯৫ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েছে ৪৬জন। আর ৯০ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েছে ৪২৫জন। আল আমীন মিশনের বীরভূমের পাথরচাপুড়ি শাখার ছাত্রী আফরিন খাতুন ৬৮৪ নম্বরে মাধ্যমিকের মেধা তালিকায় প্রথম দশে স্থান করে নিয়েছে। আর দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর ক্যাম্পাসের মোনালিসা পারভিনও একই নম্বর পেয়েছে দশম স্থান অধিকার করেছে। দুজনই দুটি করে বিষয়ে পূর্ণ নম্বর পেয়েছে অঙ্কে ও জীবনবিজ্ঞানে ১০০ করে নম্বর পেয়েছে আফরিন। আর আফরিন অঙ্কে ও জীবনবিজ্ঞানে ১০০ করে নম্বর পেয়েছে।
মিশন থেকে এবছর ১২৫১ জন ছাত্র ও ৬৩৯ জন ছাত্রীসহ মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১৮৯০ জন। মধ্যশিক্ষা পর্ষদ প্রকাশিত প্রথম থেকে দশমের মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া ১১৪ জনের মধ্যে মিশনের দুই ছাত্রীও আছে। পাথরচাপুড়ি শাখার আফরিন খাতুন ও জয়নগর শাখার মোনালিসা পারভীন উভয়েই মিশনের সর্বোচ্চ ৬৮৪ নম্বর পেয়ে এই তালিকায় দশম স্থান অধিকার করেছে। এছাড়াও মিশনের ১৭ জন ছাত্র-ছাত্রী সম্ভাব্য একাদশ থেকে কুড়িতম স্থানের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। একশো শতাংশ উত্তীর্ণ ১৮৯০ জনের মধ্যে ৯৫ শতাংশ ও তার চেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে ৪৬ জন ছাত্র ও ৩০ জন ছাত্রী সহ মোট ৭৬ জন। এছাড়াও ৯০ শতাংশ ও তার বেশি নম্বর পেয়েছে ৬৩৬ জন ( ছাত্র ৪২৫ জন এবং ছাত্রী ২১১ জন) এবং ৭০ শতাংশ ও তার বেশি নম্বর পেয়েছে ১৭৯৪ জন ( ছাত্র ১২০৮ জন এবং ছাত্রী ৫৮৬ জন)। আমরা জানি প্রথম থেকেই মিশনের উদ্দেশ্য ছিল গ্রামীন প্রান্তিক মেধাবী পড়ুয়াদের মেধার বিকাশ ঘটিয়ে রাজ্য তথা দেশের মূল স্রোতে অন্তর্ভুক্ত করা। সেকারনে এখানে মেধাবী অথচ আর্থিক দিক দিয়ে দুর্বল, এতিম ও অনাথদের বেশ বড় রকমের উপস্থিতি বরাবরই দেখা যায়। সেই ট্র্যাডিশন এবছরও দেখা গেল। মোট ১৮৯০ জনের মধ্যে ৫২১ জন অর্থাৎ ২৭.৬ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী এসেছে দুঃস্থ ও বিপিএল পরিবার থেকে। নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা যথাক্রমে ৭৩৮ ও ৬৩১ জন।
মিশনে প্রথম ও রাজ্যস্তরে দশম স্থান পাওয়া দু-জনের মধ্যে একজন মালদা জেলার কালিয়াচক থানার ভাগলপুর গ্রামের আফরিন খাতুন। মাধ্যমিক পাস আব্বা মোহা. মনিরুজ্জামানের ব্যবসা দিয়েই তাদের সংসার চলে। আফরিন ২০১৬ সালে মিশনের ধুলিয়ান শাখায় পঞ্চম শ্রেনিতে ভর্তি হয়। নবম শ্রেণিতে সে চলে আসে পাথরচাপুরি শাখায় এবং এখান থেকেই মধ্যমিক পরীক্ষায় তার এই অভাবনীয় ফল। ছোট থেকেই ছবি আঁকতে ভালোবাসে আফরিন। তার প্রিয় বিষয় জীবন বিজ্ঞান। আলাদা করে পরীক্ষার জন্য পড়াশোনার পরিকল্পনা না করেও প্রথম থেকেই সিলেবাসে মনোযোগী হয়েছিল । লকডাউন বাদে যেটুকু সময় হস্টেলে থেকেছে সেখানকার নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার পাশাপাশি ক্লাস কোচিং, গ্রুপ স্টাডি ও যেকোনো সময় শিক্ষকের সহায়তা তার সাফল্যের কারন বলে জানায় সে। আফরিন বাংলায় ৯৭, ইংরেজিতে ৯৬, গণিতে ১০০, ভৌত বিজ্ঞানে ৯৯, জীবন বিজ্ঞানে ১০০, ইতিহাসে ৯৭ ও ভূগোলে ৯৫ অর্থাৎ মোট ৬৮৪ নম্বর পেয়েছে। ভবিষ্যতে চিকিৎসক হওয়ার লক্ষে সে মিশনেরই সাঁতরাগাছি শাখায় একাদশ শ্রেনির বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছে। আল-আমীন নিয়ে তাঁর ভাবনা হল, প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে একজন ভাল মানুষ হতে অন্তত কিছু সময় হলেও মিশনে থাকা দরকার। মিশনে যুগ্মভাবে প্রথম হওয়া মোনালিসা পারভীন গণিত ও ভৌত বিজ্ঞানে একশোয় একশো পেয়েছে। এছাড়াও সে বাংলায় ৯৬, ইংরেজিতে ৯৬, জীবন বিজ্ঞানে ৯৭, ইতিহাসে ৯৬, ভূগোলে ৯৯ অর্থাৎ মোট ৬৮৪ নম্বর পেয়েছে। গ্রামীণ চিকিৎসক উচ্চ মাধ্যমিক পাস মফিজদ্দিন লস্কর ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী স্নাতক মামনী খাতুনের বাড়িতে স্বভাবতই আজ খুশির রৌশনাই। পাড়া প্রতিবেশী এবং আত্মীয় স্বজন সকলেই মোনালিসাকে মিষ্টিমুখ করাতে হাজির। মোনালিসাদের বাড়ি দক্ষিন ২৪ পরগনা জেলার জীবনতলা থানার হাওড়ামারী গ্রামে। সামান্য আয়ের পাঁচ-ছয় জনের সংসার নির্বাহে কষ্ট হলেও মেধাবী মোনালিসাকে পঞ্চম শ্রেনিতে মিশনে ভর্তি করতে তারা পিছপা হননি। এক্ষেত্রে মিশনের তরফে মোনালিসার মাসিক ফি-তে বেশ বড় রকমের ছাড় দেওয়া হয়। মোনালিসা ২০১৬ সালে মিশনের বাবনান শাখায় ভর্তি হলেও পরে স্থানান্তরিত হয় জয়নগর শাখায়। এই শাখা থেকেই সে মাধ্যমিক দেয়। ছবি আঁকতে ও গান গাইতে তার খুব ভাল লাগে। ভবিষ্যতে সে একজন সু চিকিৎসক হতে আগ্রহী কারণ এই পেশার মাধ্যমে সমাজের সুবিধা বঞ্চিত ও গরীব মানুষের সেবা করা যায়।
উচ্চ মাধ্যমিক পাস ফরিজুদ্দিনের কাপড়ের ছোট এক দোকান ছিল। মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হাসিনা বিবি সুখদুঃখের এই সংসার শক্ত হাতে পরিচালনা করতেন। মালদা জেলার বাহিরকাপ গ্রামের এই পরিবারের বড় মেয়ে নাসরিনা পারভীন ছোট থেকেই বিশাল মেধাবী। প্রথম শ্রেণি থেকেই প্রথম স্থান তার বাধা ছিল। নাসরিনের আব্বার ইচ্ছে ছিল নাসরিন ভবিষ্যতে যেন ডাক্তার হয়। কিন্তু মানুষের সব ইচ্ছে সব সময় পূরণ হয় না। নাসরিন তখন স্থানীয় হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। ২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর নাসরিনের আব্বা ফরিজুদ্দিন ইন্তেকাল করেন। নাসরিন ও তাদের পুরো পরিবার এক লহমায় সব দিক দিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। সেই কঠিন সময়ে নাসরিনের নানা ও মামারা তাদের পাশে দাঁড়ায়। তারা প্রতিজ্ঞা করে নাসরিনকে তার আব্বার স্বপ্নের ডাক্তার হতে অনুপ্রানিত করবে। সেই মতো নাসরিন ২০২০ সালে মিশনের ষোলোমাইল শাখায় নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। মিশনের তরফে এতিম নাসরিনকে খুব কম ফি-তেই ভর্তি নেওয়া হয়। মিশনে আসার প্রথম দিন থেকেই নাসরিন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় সে তার আব্বার স্বপ্ন পূরণ করবে। সেই মতো শুরু করে তার পড়াশোনা এবং এবছর মাধ্যমিকে ৬৬৯ নম্বর পেয়ে চিকিৎসক হওয়ার লক্ষ্যে এক ধাপ এগিয়ে রইল। গল্পের বই বিশেষকরে বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বড় ভক্ত নাসরিনের মা হাসিনা বিবি তার এই ফলাফল শুনে আনন্দে কেঁদেই ফেলে। মেয়েকে বলে তোর আব্বা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতো। নাসরিনের এখন একমাত্র লক্ষ্য চিকিৎসক হয়ে তাঁর আব্বার স্বপ্ন পূরণ। সে মিশনের মূল ক্যাম্পাস খলতপুরে একাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান নিয়ে পাঠরত। রাজ্যের বিভিন্ন জেলার ছাত্র-ছাত্রীদের এরকমই অসংখ্য কাহিনী মিশনের সাফাল্যগাথায় জড়িয়ে আছে। মিশনের এই ফলাফলে মিশন পরিবারের সদস্য সহ শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শুভাকাঙ্খীরা সকলেই খুশি। মিশনের সাধারণ সম্পাদক এম নুরুল ইসলাম সফল ছাত্র-ছাত্রীদের মুবারকবাদ ও দোওয়া জানিয়েছেন। তিনি বলেন করোনার কারণে পড়াশোনার বিঘ্ন ঘটলেও মিশনের সার্বিক ফলাফলে আমরা সবাই খুশি। ছাত্র-ছাত্রীদের এই সাফল্য সংখ্যালঘু সমাজের জন্য অনুপ্রেরক হয়ে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct