সজিবুল ইসলাম, ধুলিয়ান, রাজু আনসারী, অরঙ্গাবাদ, আপনজন: অসম সরকার যখন মাদ্রাসা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন পশ্চিমবঙ্গে মাদ্রাসায় অমুসলিম তথা হিন্দু ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। গত ৩০ মে পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদ পরিচালিত হাইমাদ্রাসা পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। অমুসলিমরা মেধা তালিকায় স্থান পেলেও বহু অনেকেই ভাল ফল করেছে। ২০২২ সালের হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় মোট ১৫৩১জন হিন্দু ছাত্রীছাত্রী বসেছিল। তার মধ্যে ১২৫৯জন সফল হয়েছে। এ বছর হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে সারিফা খাতুন। শুধু তাই নয় প্রথম তিনজনই ছাত্রী। এই সব ছাত্রীদের সঙ্গে আরও এক কৃতী ছাত্রী প্রচারের আড়ালে রয়ে গেছে। তবে, সে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের। সারিফা খাতুন হাইমাদ্রাসায় ৮০০ নম্বরের মধ্যে ৭৮৬ নম্বর পেয়ে যখন হিন্দু মুসলিম সব পরীক্ষার মধ্যে প্রথম হয়েছে, তখন হিন্দু ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রথম হয়েছে রাজমিস্ত্রির কন্যা পিউ সরকার। তার প্রাপ্ত নম্বর ৭১২। পিউ সরকার প্রমাণ করে দিল হিন্দু সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েদের কাছে হাই মাদ্রাসা ব্রাত্য নয়। বরং, পিউয়ের মতো ছাত্রী মাদ্রাসা শিক্ষার্জনের মাধ্যমে রাজ্যের সম্প্রীতির গৌরবকে আরও মহিমান্বিত করে তুলছে। সারা দেশে যখন শিক্ষাক্ষেত্রেও ধর্মীয় বিভাজনের প্রচেষ্টা চরছে তখন বাংলা মাথা উঁচু করে সম্প্রীতির বার্তা দিয়ে চলেছে। পিউ সরকারের মতো হাই মাদ্রাসার কৃতী ছাত্রীরা তার উজ্জ্বল স্বাক্ষর।
পিউ সরকারের বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলার ফরাক্কা থানা এলাকার মহাদেবনগর গ্রামে। বাবা শিবেম সরকার বেঙ্গালুরুতে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। মা পূর্ণিমা সরকারকে তাই সামলাতে হয় দুই কন্যা ও এক পুত্রকে। দুই কন্যার মধ্যে বড় পিউ সরকার। তাদের বাড়ির কাছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধুলিয়ান হাই মাদ্রাসা। সেখানেই পঞ্চম শ্রেণি থেকে পড়ছে পিউ সরকার। বরাবর ক্লাসের প্রথম পিউ এবার জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষায় শুধু ধুলিয়ান হাই মাদ্রাসায় প্রথম হয়নি, সারা রাজ্যের মধ্যে অমুসলিম ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রথম হয়ে নজির সৃষ্টি করেছে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল পিউ অমুসলিম হয়েও সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে ইসলাম পরিচয়ে। ইসলাম পরিচয়ে তার প্রাপ্ত নম্বর ৯৭। অন্যান্য বিষয়ে তার প্রাপ্ত নম্বর, তিনি জীবন বিজ্ঞানে ৯৬, ইংরেজিতে ৮৫, ইতিহাসে ৯৩, ভূগোলে ৯৫, বাংলায় ৮০, ভৌতবিজ্ঞানে ৮২, ও অঙ্কে ৮৪। আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে আরবি বিষয়ে ৪৬ নম্বর পেয়েছে। হিন্দু ঘরের মেয়ে হয়ে আরবি বিষয় নিয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার ঘটনা যা প্রায় বিরল। পিউ সরকার ‘আপনজন’কে জানিয়েছে, আগামী দিনে সে ভালো শিক্ষক হতে চায়। তবে তার এ সাফল্যের জন্য মাদ্রাসার শিক্ষক ও পরিবারের সহযোগিতা ছিল বেশি বলে সে জানিয়েছে। মেয়ের এই সাফল্যে বেজায খুশি তার মা পূর্ণিমা সরকার বলেন, মেয়ের ভালো রেজাল্ট করায় খুবই ভালো লাগছে। আমরা নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছি। বাড়ির কর্তা ভিন রাজ্য রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। সেই টাকাতেই কোনওবাবে সংসার চলে। যদিও পিউয়ের বাবা ব্যাঙ্গালোরে পরিযায়ী শ্রমিক। রাজমিস্ত্রির কাজ করেই জীবন নির্বাহ করেন, তিনি ফোনের মাধ্যমে মেয়ের সফলতার কথা শুনেছেন বলে পূর্ণিমা সরকার জানান।
পিউ আরও জানায়, সে আর্টস নিয়ে নিজ ধুলিয়ান হাই মাদ্রাসায় একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হবে। ছোট বোন দশম শ্রেণীর ছাত্রী ও ভাই নবম শ্রেণির ছাত্র। তবে তারা সাহেবনগর হাই স্কুলের পড়ুয়া। যদিও সে বরাবরই ধুলিয়ান হাই মাদ্রাসায় পড়াকেই বেছে নিয়েছে। হিন্দু পরিবার থেকে মেয়েকে হাই মাদ্রাসায় পড়ানো অবশ্য পিউয়ের মা পূর্ণিমা সরকার অকপটে জানান, ‘আমাদের কাছে মাদ্রাসা আর স্কুল সেটা বড় কথা নয়।শুধু সেখানে কেমন পড়াশোনা ও পরিবেশ কেমন সেটাই বেশি গুরুত্ব। ধুলিয়ান হাইমাদ্রাসায় খুব ভালো পড়াশোনা ও মাদ্রাসার পরিবেশটা খুবই ভালো। তাই মেয়েকে ভর্তি করি ওই মাদ্রাসায়। সে পরিবার ও মাদ্রাসার মুখ উজ্জ্বল করেছে। তবে আমি বলব মাদ্রাসা মানেই যে খারাপ সেই ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে আসলেই ভালো। আমার মত আরো অনেক হিন্দু পরিবারের মেয়েরা যেন এই ধরনের মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে, সেই আবেদন করব।’ ধুলিয়ান হাই মাদ্রাসার সহকারী প্রধান শিক্ষক বাইজিত হোসেন বলেন, ‘পিউ সরকার পঞ্চম শ্রেণি থেকে আমদের মাদ্রাসায় ছাত্রী। তার সফলতায় আমরা স্কুলের সমস্ত শিক্ষক খুশি, আনন্দিত। স্কুলের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা জানানো হয় পিউকে। আরো এক শিক্ষক হায়দার হোসেন বলেন, আমরা খুব খুশি পিউ সরকারের সফলতা দেখে।আগামীতে পিউ যেনো আরো ভালো সফলতা অর্জন করে সেই আশীর্বাদ করি। মূলত পিয়ের সফলতায় সম্প্রীতির বাতাবরণে খুশির আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। পিউ সরকারের এই সাফল্যে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির সভাপতি একেএম ফারহাদ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct