স্বাধীনতার ৭৪ বছর পরও ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উপার্জনের প্রধান উপায় কৃষি,অন্যদিকে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে বিনিয়োগ দেশের শিল্প, সেবা ক্ষেত্র যেভাবে ঘটেছে তার নগণ্য অংশ প্রাধান্য পায়নি কৃষিতে। কৃষির উপর ভিত্তি করে দেশের অর্থনৈতিক চাহিদাকে চাঙ্গা করার দাওয়াই কার্যত না থাকায় শিক্ষিত উচ্চশিক্ষিত নতুন কাজের সুযোগ হারায়। জীবনযাপনের ঝুঁকি এড়াতে নিজ দেশ ত্যাগ করে উন্নত দেশে পাড়ি দিয়ে বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করার পথ বেছে নেয়। এ নিয়ে লিখেছেন আমির আলি। আজ শেষ কিস্তি।
ভারতের পুঁজিপতিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বেআইনি অর্থ বা সম্পদ পাচার ক্রমাগত বাড়ায় ভারতের অর্থনীতি বেশি মাত্রায় সংকোচিত হতে থাকে। বেআইনি সম্পদ পাচারের কর্ণধাররা হলেন বিজয় মালিয়া, নিরব মোদী, মেহুল চক্সি মত মোট ৩৮ জন পুঁজিপতি ব্যাংক জালিয়াতি বা প্রতারণার ফাঁদে পড়ে দেশ ত্যাগ করে। সরকারি তথ্য থেকে জানা যায় ইউপিএ সরকার আমলে ব্যাংক জালিয়াতির পরিমাণ ছিল ২.৮৩ লক্ষ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে ৩১ শে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮.৯৯ লক্ষ কোটি টাকা, অর্থৎ মোদি সরকার আমলে মাত্র তিন বছরে অনাদায়ী ঋণ কংগ্রেস পরিচালিত সরকারের থেকে দ্বিগুণেরও বেশি। এই জালিয়াতির বেশিরভাগ অংশের টাকা বা সম্পদ ভারত থেকে পাচার হয়ে বিদেশে চলে গেছে। বিদেশে এইভাবে সম্পদ পাচার হলে ভারতের অর্থনীতির উপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। দেশের বাইরে যখন মুদ্রা পাচার হয় তখন কৃত্রিমভাবে ডলারের দাম বেড়ে যায় এবং দেশের মুদ্রা অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। বিশ্বব্যাপী কালো টাকার সবচেয়ে বড় গবেষক জার্মান অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ফ্রেডারিক স্নাইডার, তিনি মনে করেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কালো অর্থনীতি তৈরি হচ্ছে মূলত সরকারের অর্থনৈতিক কাঠামো নিয়ন্ত্রণ অব্যবস্থার কারণে। ভারতের মুক্তবাজার দর্শনে অর্থনীতি পরিচালিত হচ্ছে সেখানে পুঞ্জীর সঞ্চায়ন ও সুরক্ষা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে গ্রামজীবি মানুষের অধিকারকে ক্রমাগত উপেক্ষা করে। শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় উন্নয়নের নির্দেশক হয়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের ভৌত অবকাঠামো বিনিয়োগের ব্যয় যৌক্তিক সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে দফায় দফায়, এর মধ্য দিয়ে অনুপার্জিত মুনাফাখোরীর পথ প্রশস্ত হয় সুশাসনের ঘাটতিতে, এবং উত্থান ঘটে ক্রনি ক্যাপিটালিস্ট বা স্বজনতোষী পুঁজিপতিদের। সুশাসনের অভাবে সিংহভাগ সাধারণ মানুষ নিজের জীবন উপার্জন এবং সম্পদ নিয়ে বিচলিত বোধ করে কিন্তু তার এ দেশের বাইরে চিন্তা করার ক্ষমতা নাই বলে দেশের ভিতরে অন্যায় অনিয়মের সঙ্গে আপোষ করে চলতে হয়। সম্প্রতি অক্সফাম রিপোর্টে বলা হয়েছে ভারতের জাতীয় সম্পদের ৪০ শতাংশেরও বেশি সম্পদ রয়েছে ১ শতাংশ পুঞ্জিপতিদে্য হতে। সুশাসনের অভাবে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য তীব্রভাবে বেড়ে চলেছে। অনেকেই বিপুল পরিমাণ সম্পদ দেশে নিরাপদ বলে মনে করে না, তাই,তারা নানা প্রকৌশলে অর্থ অন্যত্র স্থানান্তরিত করে দিচ্ছে। এক দেশের অর্থ অন্যদেশে সরিয়ে একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি হলো স্থায়ীভাবে অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ। নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে কোন কোন দেশে বিশেষত কথিত ট্যাক্স ইভেন্টগুলি স্বল্প সময়ের মধ্যে নাগরিকত্ব সহ পাসপোর্ট পাওয়া যায়। এসব দেশে কখনো জানতে চাওয়া হয় না টাকা কিভাবে কোথা থেকে আনা হলো। বস্তুতঃ অর্থনীতির উত্তরণ পর্বে সম্পদ বা অর্থপাচার খুব অস্বাভাবিক বিষয় নয়। ভারতে ইদানিং সে রকম আভাসও মিলেছে তাই ভারত থেকে সম্পদ পাচার আগামীতে আরো বাড়লও বিস্মিত হবার কিছু নেই।
কিন্তু এভাবে সম্পদ পাচার বাড়লে ক্ষতি একাধিক, প্রথমতঃ অর্থপাচার প্রয়োজনীয় সম্পদকে দেশ থেকে অন্যত্র স্থানান্তর করে দেয় যা কিনা দেশে বিনিয়োগ হতে পারত এবং দেশের আর্থিক উন্নতি ঘটতো। দ্বিতীয়তঃ বিদেশে বিনিয়োগের প্রবণতা দেশের আর্থিক নেতিবাচক ধারনা তৈরি করে। তৃতীয়তঃ দেশের সম্পদ ও সামাজিক বৈষম্যকে প্রকট করে তুলে এবং সুষম উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। সেই কারণে সম্পদ পাচার পুরোপুরি বন্ধ না করা গেলেও কমিয়ে আনা খুবই জরুরি। রঘুরাম রাজনের মত বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ মোদির ভুল আর্থিক সংস্কারকে বাধা দেয়, এবং ব্যাংক জালিয়াতি ব্যক্তিদের একটি তালিকা তুলে ধরে মোদি সরকারের দপ্তরে পাঠানো হয়, এই তালিকা হাতে পাওয়ার পরও মোদি সরকার ব্যাংক জালিয়াতি পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এটাই স্বতঃসিদ্ধ যে আইনত কেন্দ্রীয় সরকারিই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সম্পূর্ণ তত্ত্বাবধায়ক, ফলে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি এবং ঋণ খেলাপি প্রকৃত দায় সম্পূর্ণ কেন্দ্রীয় সরকারের ঘাড়ে পড়ে। সুশাসনের প্রতিবন্ধকতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, জাতপাতের প্রকোপে ভারতীয় অর্থনীতি নেতিবাচক প্রভাবে পুঁজিপতিদের সম্পদ পাচার আরো ত্বরান্বিত হলে ভারতের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়ে পড়বে তা অনস্বীকার্য। (সমাপ্ত...)
লেখক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct