স্বাধীনতার ৭৪ বছর পরও ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উপার্জনের প্রধান উপায় কৃষি,অন্যদিকে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে বিনিয়োগ দেশের শিল্প, সেবা ক্ষেত্র যেভাবে ঘটেছে তার নগণ্য অংশ প্রাধান্য পায়নি কৃষিতে। কৃষির উপর ভিত্তি করে দেশের অর্থনৈতিক চাহিদাকে চাঙ্গা করার দাওয়াই কার্যত না থাকায় শিক্ষিত উচ্চশিক্ষিত নতুন কাজের সুযোগ হারায়। জীবনযাপনের ঝুঁকি এড়াতে নিজ দেশ ত্যাগ করে উন্নত দেশে পাড়ি দিয়ে বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করার পথ বেছে নেয়। এ নিয়ে লিখেছেন আমির আলি। আজ প্রথম কিস্তি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন বলেছিলেন, “কৃষি হল সবথেকে সহায়ক কার্যকরী এবং মানুষের কর্মসংস্থানের সবথেকে উল্লেখযোগ্য মাধ্যম”। স্বাধীনতার ৭৪ বছর পরও ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উপার্জনের প্রধান উপায় কৃষি,অন্যদিকে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে বিনিয়োগ দেশের শিল্প, সেবা ক্ষেত্র যেভাবে ঘটেছে তার নগণ্য অংশ প্রাধান্য পায়নি কৃষিতে। কৃষির উপর ভিত্তি করে দেশের অর্থনৈতিক চাহিদাকে চাঙ্গা করার দাওয়াই কার্যত না থাকায় শিক্ষিত উচ্চশিক্ষিত নতুন কাজের সুযোগ হারায়। ফলস্বরূপ উচ্চ মেধাসম্পন্ন ও উচ্চ শিক্ষিত জ্ঞানীব্যক্তি কাজের সুযোগ অভাবে ভালো জীবনযাপনের ব্যবস্থা না থাকা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা বা জীবনযাপনের ঝুঁকি এড়াতে নিজ দেশ ত্যাগ করে উন্নত দেশে পাড়ি দিয়ে বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করার পথ বেছে নেয়, আজও সেই মেধা প্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। আমেরিকা-কানাডা ইউরোপের দেশগুলো ভারতের মেধা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটিয়েছে। ভারতবর্ষে অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্তরায় হল মূল্যবান মানবসম্পদকে সঠিক ব্যবহার এবং তার মূল্যায়নে ব্যর্থতা।
মেধা প্রবাহ বা ব্রেন ড্রেনে ভারতের অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রভাব যতটা পড়েছে, পরিসংখ্যান তথ্য থেকে স্পষ্ট যে মোদি সরকার আমলে সম্পদ পাচারে গতি ভারতের অর্থনীতির উপর আরও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে যা স্বাধীন ভারতের অতীত ইতিহাসে ঘটেনি। ভারত থেকে পুঁজিপতি, উদ্যোগপতি নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে পাড়ি দিয়েছে পশ্চিমা দেশে। পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে ২০১৪ সালের বিগত চোদ্দ বছরে ভারত থেকে ৬১ হাজার পুঁজিপতি বিদেশে প্রস্থান করেছে। গ্লোবাল ওয়েলক মাইগ্রেশন রিভিউ পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৩৫ হাজার উচ্চ সম্পদশালী ব্যক্তি আর্থিক বিনিয়োগে নাগরিকত্ব পায় এবং স্থায়ীভাবে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয়সমূহে বসবাসের সুযোগ অর্জন করে। সম্প্রতি এশিয়া ব্যাংক, নিউ ওয়ার্ল্ড মোস্ট ওয়েলথ্ যৌথ উদ্যোগে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ইহাতে উল্লেখ আছে- উচ্চ সম্পদ ব্যক্তিদের প্রায় দুই শতাংশ যা প্রায় ৬ হাজার পুঁজিপতি বা উদ্যোগপতি ২০১৮ সালে ভারত থেকে স্থানান্তরিত হয়। মোদি সরকারের হঠোকারী সিদ্ধান্তে মাঝারি মাপের পুঁজিপতিদের সম্পদ পাচারর গতি অতি মাত্রায় বেড়ে যায় ফলে ভারতীয় অর্থনীতি আরও সংকুচিত হয়ে পড়ে।
সম্পদ পাচারে বিশেষ কারণগুলি উল্লেখ করলে দেখা যায় কোভিড, রাজনীতি অস্থিরতা, সামাজিক অস্থিরতা, আয়কর দপ্তরের ট্যাক্সে অত্যধিক চাপ থেকে অব্যাহতি পেতে অনেক পুঁজিপতি আইনসম্মতভাবে নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোকে বেছে নেয়। দ্বিতীয়তঃ জলবায়ু পরিস্থিতি, উন্নত শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা, কর ব্যবস্থা সুযোগ সুবিধা, নিরাপত্তার কারণে পুঁজিপতিরা বিদেশে নিজেদের পছন্দমত স্থানগুলো বেছে নেয়। তৃতীয়তঃ মোদি সরকার মাঝারি মাপের পুঁজিপতিদের প্রতি উদাসীনতা দেখিয়েছে। আম্বানি মত দৈত্য পুঁজিপতি প্রতি মোদি সরকারের নজর বেশি এবং ভারতীয় ব্যাংকগুলি থেকে খুব বেশি সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দেওয়া ফলে মাঝারি পুঁজিপতিদের গ্রাস করতে সুবিধা হয়। ফলে, মাঝারি ধরনের পুঁজিপতিরা বিদেশি বিনিয়োগ করে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। চতুর্থত, ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালে পাসপোর্ট সূচকে ভারতীয় পাসপোর্টের ব্যাঙ্কিং ৬০ থেকে নেমে ৯০ পৌঁছিয়েছে। ভিসামুক্ত ভ্রমণের অনুমতি কমে গেলে ভারতীয় পুঁজিপতিদের বিদেশে ব্যবসার গতি কমে যায়। ভিসামুক্ত ভ্রমণ দেশের অর্থনৈতিক শক্তি ও নাগরিকদের ব্যবসার গতি প্রবৃদ্ধি ঘটাতে সাহায্য করে। পশ্চিমা দেশের পাসপোর্টের সুযোগে ভারতীয় পুঁজিপতিদের বিনিয়োগ বড় রকম সাহায্য করে। বিশ্বায়নের ফলে আইনসম্মত সম্পদ পাচার ক্রমাগত ভারতীয় পুঁজিপতিদের বেড়ে চলেছে। যদিও মোদি সরকার দেশের পুঁজিপতিদের বিনিয়োগ বাড়াতে একটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন-”ইজি অফ ডুইং বিজনেস” এই উদ্যোগের উপর জোর দেওয়া সত্বেও উদ্যোগপতিদের ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। মোদি সরকার বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতি বলে দাবি করলেও পুঁজিপতিদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতেও ব্যর্থ হয়েছে।
লেখক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct