ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ যখন পুরো বিশ্বপরিস্থিতি আমূল পাল্টে দেয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি করছে তখন মধ্যপ্রাচ্যে ঘটনাবলির নতুন বিন্যাসের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এই অঞ্চলে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য নানা ঘটনা ঘটছে, যাতে মনে হয় বিশ্বের সবচেয়ে সংবেদনশীল এই এলাকায় বড় কোনো বিন্যাস তৈরি হচ্ছে। কূটনৈতিক তৎপরতায় ওয়াশিংটনের কিছু ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ‘উত্তেজনা কমানো’ এবং ‘পুনর্বিন্যাস’ নিয়ে গুঞ্জন রয়েছে। এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হিসেবে দেখা হয়। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ তৃতীয় কিস্তি।
সাইবার ওয়্যারফেয়ারের আবির্ভাব একমাত্র প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নয়, যা যুদ্ধবিপ্লবের জন্য হুমকিস্বরূপ। শিল্প যুগে সঙ্ঘাতকে ট্যাংক, যুদ্ধজাহাজ, বিমান ইত্যাদি যান্ত্রিক প্লাটফর্ম দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল। যখনই বিশ্লেষকরা একটি রাষ্ট্রের সামরিক শক্তি মূল্যায়ন করতে চান বা যুদ্ধে দুই পক্ষের আকার বাড়াতে চান, তারা অবিলম্বে তাদের প্লাটফর্মগুলো হিসাব করেন। তাদের কত ট্যাংক আছে এবং কী ধরনের ট্যাংক বা কয়টি প্লেন আছে? বিভিন্ন ধরনের জাহাজ আছে কয়টি? এখন প্রতিরক্ষা সক্ষমতার সেই হিসাব পাল্টে যাচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যে শক্তির প্রতিযোগিতা
নতুন পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলো কৌশলগতভাবে কে কার সাথে আছে তা জানা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে জার্মানি এবং এর শেষার্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের মতো কিছু সামরিক বাহিনী শক্তিমান ছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কারণে আরব রাষ্ট্রগুলো কখনোই সেই পর্যায়ে যেতে পারেনি। আজ নতুন নতুন সামরিক প্লাটফর্মের গুরুত্ব বাড়ছে। বিশ্বের এখন প্রায় পাঁচ দশক ধরে স্মার্ট যুদ্ধাস্ত্র রয়েছে এবং তারা ক্রমবর্ধমানভাবে যেকোনো যুদ্ধক্ষেত্রে প্রভাবশালী মেশিন হয়ে উঠছে। এফ-৩৫-এর সামর্থ্যরে সমন্বয় ভবিষ্যতের যুদ্ধের আরেকটি তরঙ্গ উপস্থাপন করে। এর উজ্জ্বল সেন্সরগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা উন্নত যুদ্ধ-ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির মাধ্যমে পরিচালিত। এগুলো সমানভাবে উজ্জ্বল দূরপাল্লার যুদ্ধাস্ত্রের সাথে যুক্ত। গোলাবারুদগুলো সরাসরি সেন্সর থেকে তথ্যের দ্বারা পরিচালিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ-ব্যবস্থাপনা প্রোগ্রাম দ্বারা পরিচালিত হবে এমন যেকোনো মানুষের চেয়ে অনেক বেশি তথ্য ট্র্যাক রাখতে সক্ষম হতে পারে। একই সাথে এই সরঞ্জামগুলো দ্রুত লক্ষ্য এবং হুমকি শনাক্ত করতে পারে, তাদের ধ্বংস করার জন্য অস্ত্র বরাদ্দ করতে পারে এবং অস্ত্রগুলো চালু করতে পারে। এফ-৩৫ এবং অনুরূপ জটিল অস্ত্র অত্যন্ত ব্যয়বহুল। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ যথেষ্ট ধনী, তাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষার জন্য যথেষ্ট প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের অধিগ্রহণ করার জন্য যথেষ্ট বন্ধুত্বপূর্ণ। ইসরাইলের এফ-৩৫ বিমান রয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এগুলো পরে পাবে এবং সৌদিরাও শেষ পর্যন্ত সম্ভবত এগুলো পাবে। তবে মিসর, ইরাক এবং জর্দানের পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। তবে এর মধ্যেই প্রতিরক্ষা সম্ভাবনায় নতুন কিছু আসছে।
সিদ্ধান্তকারী অস্ত্র ড্রোন ও তুরস্ক!
এখন ড্রোনগুলো তথ্যযুগের যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে দ্রুত আবির্ভূত হচ্ছে। ড্রোন মনুষ্যবিহীন এবং নিজেই চূড়ান্ত তথ্যসমৃদ্ধ যুদ্ধাস্ত্র। যুদ্ধে নাগরিকদের বলি দিতে নারাজ দেশগুলোর কাছে ড্রোন আকর্ষণীয়। তা ছাড়া অনেক ড্রোনের যথেষ্ট পরিসর, অন্তর্নির্মিত সেন্সর, স্টিলথ ক্ষমতা এবং লক্ষ্যে নির্ভুল আঘাত হানার ক্ষমতা রয়েছে। অনেক সস্তা ড্রোন প্রথাগত প্রাথমিক সতর্কতা এবং আকাশ প্রতিরক্ষা রাডারসহ অনেক বেশি ব্যয়বহুল প্রযুক্তির মাধ্যমে শনাক্তকরণ এড়াতে পারে। একইভাবে ব্যয়বহুল বিমান প্রতিরক্ষা অস্ত্র দ্বারা ধ্বংস করাও কঠিন এবং দুর্বল লক্ষ্যবস্তুতে বেদনাদায়ক ক্ষতি সাধনে সক্ষম।
ড্রোন অনেক ক্ষেত্রেই সর্বতোভাবে শক্তিমান না হলেও তাদের নিজস্ব ক্ষমতাকে সমন্বিত করা এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য ভবিষ্যতের পাল্টা ব্যবস্থাগুলোকে অতিক্রম করার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক দেশ মাইক্রোড্রোনের ওপর কাজ করছে, যা আরো সহজে শনাক্তকরণ এড়াতে পারে। অনেক দেশ ড্রোনের প্রধান দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে কঠোর পরিশ্রম করছে। স্থলভাগে কোনো অপারেটরের কাছ থেকে তাদের কিছু ধরনের নির্দেশনার প্রয়োজন। অত্যাধুনিক কমান্ড-অ্যান্ড-কন্ট্রোল সিস্টেম এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা পরিচালিত স্বচালিত ড্রোন সেটি দূর করতে পারে। ৭৫ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য বিশ্বের মহা অস্ত্র পরীক্ষাগারে পরিণত হয়েছে। প্রধান অস্ত্র প্রস্তুতকারী সোভিয়েতরা মিসরে, আমেরিকানরা ইরাকে আর রাশিয়ানরা সিরিয়ায় যুদ্ধে তাদের সর্বশেষ হত্যা মেশিন পরীক্ষা করেছে। আশ্চর্যজনকভাবে সস্তা থেকে স্বল্প ব্যয়বহুল ড্রোনও তা থেকে আলাদা নয়। এগুলো ক্রমবর্ধমান হারে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধগুলোতে আধিপত্য বিস্তার করছে এবং এই অঞ্চলের সামরিক ভারসাম্যকে প্রভাবিত করছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct