ঘরবন্দি
এরসাদ মির্জা
___________________
মা রান্নাঘরে ব্যস্ত। রোজকার মতো। সকাল সকাল বাবা বেরিয়ে যায় কাজে। তাই রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে, মাকে বিস্তর সময় কাটাতে হয় রান্নাঘরের থালা-বাসন ও গ্যাস-ওভেনের সাথে। সকালের নাশতা ও বাবার জন্য টিফিনে ভরে দেওয়া খাবার, সবটাই তৈরি করতে হয় একসাথে। বিধায় সকালবেলা মায়ের ফুরসৎ নেই বিন্দুমাত্র। কিন্তু সকালের এতোসব কাজের চাপে মা কোনদিন নুইয়ে পড়েনি। তুলেনি কোনদিন কোনও অভিযোগ। বরং ঘামে ভেজা গায়ে, বাড়ির সবার সাথে সকালের নাশতাটা করতে তার বেশ ভালোই লাগে। তবে সে ভালো লাগায় চিড় পড়েছে মাসকয়েক ধরে। বাড়ির একমাত্র মেয়েটি নাশতায় সবার সাথে শরিক হয় না। এমনকি সকালের আহারটাও রোজ ঠিকমতো করে না। অজানা কোনো এক কারণে সে খুব কষ্টে ভুগছে। নিজেকে ঘরবন্দি করে দিনমান পড়ে থাকে বিছানায়। কারো সাথে মিশতে চায় না। খেতেও চায় না। আজও মা ওভেন জ্বালিয়েছে। নাশতা হচ্ছে। সঙ্গে বাবার টিফিনের খাবারও। কিন্তু তার চেহারায় আনন্দের লেশমাত্র নেই। বিষাদে ভরা মন নিয়ে আনমনে পালন করে চলেছে রোজকার ডিউটি। আর মনের ভিতর আকুতির ঝড় বইছে- মেয়েটি যদি একবার উঠে এসে সবার সাথে বসত নাশতায়!হাতে খুন্তি নিয়ে মা নেড়ে চলেছে কড়াইয়ে চড়ানো ফোড়নগুলো। আর মেয়ের ভাবনায় চোখের কোণে অশ্রুকণা ভিড় করছে। তখনই কানে এলো দরজা খোলার শব্দ। মাথা কাত করে দেখতে গিয়ে চমকে উঠল। তানিয়া! ব্রাশ হাতে তানিয়া ঘর থেকে বের হয়ে সোজা ঢুকল বাথরুমে। মায়ের মনটা নেচে উঠল। খুশিতে চোখ ভরে এলো। ওভেনের আঁচ বাড়িয়ে দিল। তানিয়া আজ সকালে উঠেছে। ঘর থেকে বেরিয়েছে। কত্তদিন পর আবার সবাই একসাথে খেতে বসব!
টেবিলে প্লেট সাজিয়ে মা নাশতা বেড়ে দিল। তানিয়াকে আদরমাখা কণ্ঠে দু’বার ডাক দিল। কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। আবার দরজা বন্ধ করে নিজেকে ঘরবন্দি করে নিয়েছে সে। কি আশ্চর্য! মা ডাক দিতে থাকল- ‘উঠেছিস যখন, তখন একটুখানি খেয়ে নে, মা!’ কোনো উত্তর নেই। অবাক চোখে মা দাঁড়িয়েই থাকল তার ঘরের সামনে কিছুক্ষণ। দেখল, ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে দরজাটা খুলল। আর ভিতর থেকে নতুন পোশাক গায়ে তানিয়া বেরিয়ে এলো, ব্যাগ হাতে। মা অবাক! কোথায় যাচ্ছে তানিয়া এভাবে, এতো সকালে? ভয়ার্ত কন্ঠে শুধাল, ‘কোথায় যাচ্ছিস, তানি, এভাবে?’ জবাবে পেল শুধু, ‘একটু আসছি।’ দিশেহারা হয়ে গেল মা। বলল, ‘মানে? “একটু আসছি” মানে কী? কোথায় যাচ্ছিস তুই?’ সেই একই জবাব আবার দিল তানিয়া। হাল ছেড়ে দিল মা। বলল, ‘একটুখানি কিছু মুখে তো দিয়ে যা...!’ এবার অবাক করে দিয়ে মায়ের দিকে চেয়ে একটু মুচকি হাসল তানিয়া। বলল, ‘রাতের খাবারটা জোরদার করিও, মা। আজ একসাথে বসে পেট ভরে খাব।’ বলেই তানিয়া হনহন করে বেরিয়ে গেল। কাউকে কিছু বলার সুযোগ দিল না। কোথায় যাচ্ছে বলে গেল না। সবকিছু সবাইকে বলা যায় না। খুব আপন হলেও না। কিছু জিনিস থাকে এমন-ই স্পেশাল। আর আজ তো ‘স্পেশাল’ কারো জন্য সারপ্রাইজ! অতএব সে তো কাউকে-ই শেয়ার করা চলবে না। হ্যাঁ, স্পেশাল কারো জন্য আজ তানিয়া বিষাদের পোশাক খুলে ফেলেছে। পা মাড়িয়েছে বদ্ধঘরের গণ্ডির বাইরে। আজ সে সারপ্রাইজ দেবে, বুকে আঁকড়ে ধরবে ঘরছাড়া তার স্পেশালম্যান আসিফকে।
আসিফ তার স্বপ্নের রাজকুমার। বছরদুয়েক আগে বহরমপুর স্কোয়ার ফিল্ডে প্রথমবার দেখা হয় মালদার ডাক্তারি পড়ুয়া আসিফের। প্রথম চোখাচোখিতেই বিনিময় হয় কাছে আসার আকুতি। রচিত হয় একসাথে পথ চলার নকশা ও ছায়া-সঙ্গী হয়ে জীবনভর পাশে থাকার বিধান। পঠিত হয়, মুখ ফিরিয়ে না নেওয়ার চরম শপথ বাক্য। রাত জেগে ফোন কল, ঘনঘন দেখা, নানান উপলক্ষে উপহারের ফুলঝুরি প্রভৃতিতে ভরে উঠে জীবনের নিত্য শিডিউল। খুশি-আনন্দের শিডিউল। এরপর একদিন সেই শিডিউলে একটু বদল ঘটল। স্বপ্নার্জনে দিল্লির জামেয়া হামদার্দে পাড়ি জমালো আসিফ। প্যাথোলোজি নিয়ে অধ্যায়ন করতে। একই গন্তব্যমুখী দুটি পাখি দুটি ভিন্ন শহরে আটকা পড়ল। নিত্যদিনের শিডিউলের বদলটা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকল। দেখা করা বন্ধ হয়ে গেল, রাতের ফোন-কল কমে এলো, টেক্সট করা বিরক্তিকর হয়ে উঠল। জীবনের যত স্বপ্ন, যত আশা, সব ঘোলাটে হতে শুরু করল। আর এর মাঝেই একদিন হঠাৎ করে ধেয়ে এলো এক ঝঞ্ঝা। জীবনের সাজানো গোছানো সবকিছু সে এলোমেলো করে দিল। আর খাড়া করে তুলল লং-ডিসটেন্স-রিলেশনশিপের মাঝে এক বৃহৎ অবহেলা ও সন্দেহের পাহাড়। এবং অচিরেই মধুর সম্পর্ককে পর্যবসিত করল এক করুণ ব্রেক-আপে। আসিফের থেকে ব্রেক-আপের শেষ টেক্সটটা পাওয়ার পর অন্ধকার নেমে আসে তানিয়ার জীবনে। সে লোকের সাথে মেশা বন্ধ করে দেয়, হাসতে ভুলে যায়, নিজেকে ঘরবন্দি করে নেয় এবং খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেয়। কারও উপদেশ তার কানে ঢুকেনি। কারও কথার ভ্রুক্ষেপ করেনি। তার মন চেয়েছিল আসিফের কাছে ছুটে যেতে। আবার তার রাজকুমারকে ফিরে পেতে। কিন্তু ও তো দিল্লিতে! মুখ বুজে বুকভাঙা ব্যথা সহ্য করা ছাড়া তানিয়ার আর কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু আজ সকালে সোশ্যাল মিডিয়ায় আসিফের বাড়ি ফেরার পোস্ট দেখতেই তানিয়া জেগে উঠেছে। মনস্থির করে ফেলেছে, রেলস্টেশনেই সে আসিফের সাথে দেখা করবে। পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে ভুলের ক্ষমা চাইবে। ফিরে আসার আকুতি জানাবে।
সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে তানিয়া সোজা এসে পৌঁছায় মালদা স্টেশনে। পাঁচঘন্টা ধরে সেখানেই সে অপেক্ষা করছে অধীরচিত্তে। কলকাতা থেকে আগত ট্রেনটি স্টেশনে পৌঁছতে এখনও দেড়ঘন্টা বাকি। তানিয়া তবু অধৈর্য হয়নি। সে গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তার আসিফের আগমনের। আর বিমগ্ন হয়ে ভেবে চলেছে- কীভাবে আসিফেকে জড়িয়ে ধরবে, কী বলে ক্ষমা চাইবে, কীভাবে ফিরে আসার আকুতি জানাবে- এমন নানান সব কথা। হঠাৎ তার ধ্যান ভাঙল ট্রেনের বিকট শব্দে। দেখল, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে। লাফিয়ে উঠল তানিয়া। প্রস্থান গেটের কাছে একপাশে আড়ালে দাঁড়াল তানিয়া। হিড়হিড় করে ধেয়ে আসতে থাকা যাত্রীদের মাঝে সে খুঁজতে থাকল অতিপরিচিত মুখটি। কিন্তু সে কই? হ্যাঁ, ঐ তো আসছে! মুখে হালকা দাড়ি, ট্রিমড্ করা। মাথার চুলগুলো ঢেউ খেলিয়ে দুলছে। হাতে ট্রলি আছে কি না দেখা যাচ্ছে না। মানুষের যা ভিড়! ভিড়ের সাথে সেই পরিচিত মুখটিও আগিয়ে আসছে গেটের দিকে। তানিয়ার মন ধুকপুক করছে। ভাবছে, আসিফ কি তাকে দেখতে পেয়েছে? দেখলে সে কি পাশ কেটে পালাবে? এমন সব ভাবতে ভাবতেই লক্ষ্য করল যে, আসিফ ভিড়ের সাথে মিশে গেটের একদম কাছে চলে এসেছে। তানিয়া আড়াল থেকে বেরিয়ে, বুকে সাহস নিয়ে ভিড়ের মাঝে মিশে গেল, ভিড় ভেদ করে তার আসিফকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরব বলে। উঃ সামনের লোকটা সাইড দিচ্ছে না! পাশ কাটিয়ে তানিয়া বাঁ দিকে গিয়ে তার আসিফকে পেছন থেকে ‘জাদু কি ঝাপ্পি’ দিতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। তার মাথার উপর চাঁদ ভেঙে পড়ল। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এলো। তার আশার আলো নিভে গেল। সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। এ কী দেখছে সে? আসিফের হাতে পাশের স্কার্ফ পরা মেয়েটির হাত?! আসিফের সামনে আর এলো না, সোজা বাড়ি রওনা দিল তানিয়া। মা রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিল রান্নায়। মেনুতে আজ অনেক কিছু রয়েছে। বাড়িঘর গন্ধে ভরে উঠেছে। তখনই নির্বাক ও ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বাড়িতে প্রবেশ করল তানিয়া। বারান্দার আবছা আলোয় তানিয়াকে দেখে রান্না ঘর থেকে প্রফুল্ল মনে জোর গলায় মা বলল, ‘এলি, তানি? আজ খেতে খেতে আমাকে সব বলতে হবে কিন্তু, তুই কোথায় গিয়েছিলি...।’ বলে মা গুনগুন শব্দ করে রান্নায় মশগুল হয়ে গেল। আর তানিয়া ঘরের দরজা বন্ধ করে আবার নিজেকে ঘরবন্দি করে ফেলল!
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct