মোরা সকলেই রয়েছি বর্ষার প্রতীক্ষায়
সনাতন পাল (শিক্ষক এবং বিশিষ্ট সাহিত্যিক)
_________________________________
বর্ষার একখানা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-” সকল বয়সেরই একটা কাল আছে। যৌবনের যেমন বসন্ত, বার্ধক্যে যেমন শরৎ, বাল্যকালের তেমনি বর্ষা। গীতবিতানে প্রায় 120 টি বর্ষার গান রয়েছে। এই গান গুলি প্রকৃতির সাথে মানুষের একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে দিয়েছে , একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই । বৈশাখের সারাদিনের প্রখর রোদ্দুর পেরিয়ে বিকেল হলেই লাল টুকটুকে কৃষ্ণচূড়ার যেমন একটু নিজকে জিরিয়ে নেবার সময় আসে তেমনি জৈষ্ঠের আম- কাঁঠাল পাকা গরম পেরিয়ে চাতকের গলা তেষ্টায় শুকিয়ে যাবার পালা শেষ করে রুগ্ন দুর্ব্বার শুকিয়ে যাওয়া শরীরের নতুন করে কচি ডগা জন্মানোর আশায় আষাঢ়ের দিকে একটু মুখ চেয়ে থাকা প্রতিক্ষার অবসান ঘটে। জৈষ্ঠের চড়া রোদে মাঠ ফেটে চৌচির, প্রতিক্ষায় রয়েছে একটু বৃষ্টির জলের জন্য । বোরো ধান কাটা হয়ে গেছে, ধূ ধূ ফাঁকা মাঠ দিগন্তরেখায় মিশেছে। কাল বৈশাখীর দাপটে গাছের ডাল ভেঙে লটকে রয়েছে, পুরাতন পাতা ঝরে গেছে, নতুন পাতা গজানোর সময় উপস্থিত। আমের বনে পাগল করা মুকুলের ঘ্রাণ না থাকলেও প্রকৃতির যেন চারিদিকে সাজো সাজো রব। প্রকৃতি যেমন তীব্র তাপদাহ থেকে হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে চাইছে বর্ষার শীতল বারি ধারা তেমনি আমরাও প্যাঁজ প্যাঁজে ঘামের গন্ধ আর তীব্র গরমে হাঁসফাঁস থেকে একটু শান্তির নিঃশ্বাস নিতে চাইছি বর্ষার আগমনে। সে আসবে হয়তো আষাঢ়ের কোনো এক লগ্নে। তখন মাঠ আবার সবুজ ঘাসে ভরে উঠবে, গাছে গাছে নতুন পাতায় ভরে যাবে । প্রকৃতি হয়ে উঠবে গাঢ় সবুজ। বেজে উঠবে গীতবিতানের সেই বর্ষার গান। প্রকৃতি যেমন হয়ে উঠবে শ্যামল তেমনি মুখরিত উঠবে বাংলার আকাশ বাতাস। রূপের ছটায় নিজেকে মেলে ধরবে জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, স্তব্ধ হয়ে যাবে’ বনলতা সেন’। গাছে গাছে কদমের ফুল , ঝরা বকুলের গন্ধ , দোলনচাঁপা সন্ধ্যামালতী আর কামিনীর গন্ধে মুখরিত দক্ষিণা মলয়। সুরের ঝংকারে বেজে উঠবে- “ আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে জানিনে জানিনে কিছুতে কেন যে মন লাগে না।” চঞ্চল সজল পবন যেমন ধেয়ে আসবে, তেমনি বারিধারার সুধা পান করে পৃথিবী পরিতৃপ্ত হবে। আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা আর গুরগুর ডাক মাঠে থেকে চাষীদের ফেরার তাড়া এবং দেখা যাবে বাঁশের খুঁটিতে দড়ি দিয়ে বাঁধা গরুর পালের গোয়ালে ফেরার জন্য হাম্বা হাম্বা ডাক! কখনও দেখা যাবে কালো মেঘের নীচ দিয়ে উড়ে যাওয়া সাদা বকের পাল। মাঠের দূর প্রান্ত থেকে সাদা হয়ে ছুটে আসতে দেখা যাবে বৃষ্টির ধারা । একটু অসাবধান হলেই ভিজিয়ে দিয়ে যাবে।
ভেজা কাক গুলোর কা কা ডাক আর ভেজা পাখিদের আপন নীড়ে ফেরার চঞ্চলতা সবাই কে বুঝিয়ে দেবে বর্ষা এসেছে। যে নদী গুলো বৈশাখে হাঁটু জল ছিল সেখানেই চলবে পালতোলা নৌকা। মাঝিদের দেখা যাবে স্রোতের মাঝে নৌকার দাঁড় টাকে ধরে শরীরকে হেলিয়ে দিয়ে নৌকা চালানো। খেয়া ঘাটে জমবে পারাপারের ভিড়। পিছল ঘাটে ভরা জলের কলসি নিয়ে মাথা নিচু করে পা টিপে টিপে গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে যাবে বধূরা আপন খেয়ালে। গঙ্গার তীরে স্রোতের উপর মেঘের ছায়া, জলের উপরে জল বিন্দুর নৃত্য, ওপারের বনের শিয়রে মেঘের উপর মেঘের ঘটা আর মেঘের তলে সেই অশ্বত্থ গাছ, বিস্তীর্ণ মাঠে শস্যের উপর দিয়ে হেঁটে আসা বর্ষার পদধ্বনি ঘরের জানালা দিয়ে দেখা সেই দৃশ্য ছেলেবেলা থেকে বার্ধক্য বহুবার ফিরে ফিরে আসে। বাদল দিনে যখন ছেলে শোনে মায়ের খালি গলায় রবীন্দ্রনাথের সেই গান-” আমার পাগলা হাওয়া বাদল দিনে....”। তখন ছেলে আলাদা করে আর রবীন্দ্রনাথ কে খুঁজতে যায় না, রবীন্দ্রনাথ কে অনুভব করে তার এলোকেশী মাতৃ কন্ঠে। রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় বর্ষা ঋতুটা ধরা দিয়েছে এক স্নিগ্ধ শ্যামল সুন্দর রূপে। একমাত্র কালিদাসের-’ মেঘদূত ‘ ছাড়া বর্ষার কাব্যগাথা কোনো সাহিত্যে এমন রূপে বাঁধা পড়েনি। মেঘদূতে যেমন সমস্ত অন্তর্বেদনা নিত্যকালের ভাষায় লেখা হয়েছে তেমনি রবীন্দ্র সাহিত্যে, সংগীতে বর্ষা এসেছে এক অবর্ণনীয় কবিত্বগাথা, মানব হৃদয়ের অপরূপ ভাষায়। মেঘকে তুলনা করা হয়েছে কাজল কালো চোখের সাথে। “ হেরিয়া শ্যামল ঘন নীল গগনে সেই সজল আঁখি পড়িল মনে।” করুণামাখা অধর মিনতির বেদনা এঁকে নীরবে চেয়ে থাকে বিদায় ক্ষণে। ঝরঝর বৃষ্টি ঝরে বিজলি আঘাত হানে বাতাস পাগল হয় পরাণ পুটে হৃদয় কোণে কার কথা যেন জেগে ওঠে।
‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা, নিশীত যামিনী রে কুঞ্জপথে, সখি, কৈসে যাওব অবলা কামিনী রে।’ ‘শাল পিয়াল তমাল বনে বাঁশি বাজছে। ঘন হয়ে মেঘ আসছে। সখি বল, এ দুর্যোগে কোথা গেলে রাধাকে পাওয়া যাবে।’ আকাশে মেঘের পরে মেঘ জমেছে। ফলে পৃথিবী আঁধারে ছেয়ে গেছে। এমন সময় আমায় কেন একলা ঘরের কোণে বসিয়ে রাখো। কাজের দিনে নানা কাজ থাকে। তখন আমি কাজের মাঝেই ডুবে থাকি। কিন্তু আজ আমি তোমারই আশ্বাসে বসে আছি। ‘তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা, কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল বেলা।’ ‘দূরের পানে আঁখি মেলে চেয়ে থাকি পরান আমার কেঁদে বেড়ায় বৃষ্টিভেজা মিষ্টি বাতাসে কখন আসবে তুমি।’ গানটিতে আকুল করা প্রেমিকের করুণ আর্তি ফুটে উঠেছে। ‘যেতে দাও যেতে দাও গেল যারা তুমি যেয়ো না, তুমি যেয়ো না, আমার বাদলের গান হয়নি সারা।’ কুটিরে কুটিরে দ্বার বন্ধ। নিভৃত রজনী অন্ধকারে ডুবে আছে ঘুমহীন চঞ্চল বাতাসে কেঁপে উঠছে। দীপ নিভেছে নিভুক। আঁধারেই তোমার পরশ রাখো। তোমার হাতের কাঁকন বেজে উঠুক আমার গানের তালের সাথে। যেমন- নদীর ছলো ছলো জলে ঝরো ঝরো ঝরো শ্রাবণধারা...’। মোরা সকলেই রয়েছি তোমারই প্রতিক্ষায়, কখন আসবে তুমি?
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct