স্বস্তির কথা, সুপ্রিম কোর্ট দেশদ্রোহ আইনের প্রয়োগ স্থগিত রেখেছেন। কেন্দ্রীয় সরকার আইনটি পুনর্বিবেচনা ও পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সুপ্রিম কোর্টের ওই নির্দেশ। পুনর্বিচারে রাজি হলেও সরকার অবশ্য আইন স্থগিত রাখার পক্ষে ছিল না। অবশ্য বিবেচনার অর্থ এই নয় যে সরকার শেষমেশ আইনটি খারিজের পক্ষে মত দেবে। সে যা-ই হোক, সর্বোচ্চ আদালতের এই নির্দেশ সরকারের কাছে এক বড় ধাক্কা। কেন্দ্রীয় সরকার দেশদ্রোহ আইন পর্যালোচনায় রাজি হল। এ নিয়ে লিখেছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ শেষ কিস্তি।
যেমন ‘আনলফুল অ্যাকটিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্ট’, সংক্ষেপে যা ‘ইউএপিএ’ নামে পরিচিত। ১৯৬৭ সালে এই আইন তৈরি হয়েছিল দেশের ‘অখণ্ডতা’ রক্ষার তাগিদে। সেই থেকে ছয়বার এই আইন সংশোধিত হয়েছে। সবচেয়ে মারাত্মক সংশোধনীটি এনেছে নরেন্দ্র মোদির সরকার, ২০১৯ সালে। সেই সংশোধনীর ফলে শুধু সন্ত্রাসবাদী সংগঠনই নয়, সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা সরকার পেয়েছে। বন্দী হয়েছেন ভারভারা রাও, সুধা ভরদ্বাজ, ভারনন গনজালভেস, শারজিল ইমাম, আনন্দ টেলটুম্বে, সোমা সেনদের মতো বিরুদ্ধবাদীরা। প্রবীণ স্ট্যান স্বামী তো বন্দী থাকাকালে মারাই গেলেন! শাসক দলের শীর্ষনেতারা তত দিনে ‘দেশপ্রেমী’ও ‘দেশদ্রোহী’র সংজ্ঞাও নির্ধারণ করে দিয়েছেন! ছড়িয়ে দিয়েছেন ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’, ‘আরবান নকশাল’-এর মতো শব্দবন্ধ। বিনা বিচারে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর গণহারে আটকে রাখার এমন উদাহরণ ভারত আগে দেখেনি। বৈপরীত্যও। জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট দেবীন্দর সিং নিজের গাড়িতে দুজন হিজবুল মুজাহিদিন জঙ্গিসহ গ্রেপ্তার হলেন, চাকরি থেকে বরখাস্ত হলেন এবং জামিনও পেয়ে গেলেন! অথচ জেলে পচছেন হাজার হাজার আন্দোলনকর্মী, সাংবাদিক, সমাজের দুর্বল শ্রেণির অধিকারের জন্য যাঁরা সরব!
রাষ্ট্রসংঘ ছাড়াও বিভিন্ন মানবাধিকার রক্ষার সংগঠন এই আইনকে ধিক্কার জানিয়েছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর ২০১৪-২০ সালের মধ্যে ‘ইউএপিএ’ আইনে দেশে ৬ হাজার ৯০০টি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। অর্থাৎ বছরে গড়ে রুজু হয়েছে ৯৮৫টি করে মামলা। সবচেয়ে বেশি মামলা ২০১৯ সালে। ১ হাজার ২২৬টি। আগের বছর, ২০১৮ সালে রুজু হয় ১ হাজার ১৮২টি মামলা। প্রতিটি মামলায় গ্রেপ্তার একাধিক ব্যক্তি। দেশদ্রোহ আইন বাতিল হলেও ‘ইউএপিএ’ রয়েছে বহাল তবিয়তে। তবু সরকারের এত হাহুতাশ! দমনমূলক আইন আরও আছে। যেমন ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ বা ‘এনএসএ’। কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার যাকে রাষ্ট্রবিরোধী মনে করবে, তাকে সহজেই এই আইনে গ্রেপ্তার করা যায়। বিস্ময় এই যে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো, যে সংস্থা সব ধরনের অপরাধের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে, তাদের কাছেও ‘এনএসএ’-সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য নেই। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জি কিষাণ রেড্ডি সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় জানিয়েছিলেন, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে এই আইনে ১ হাজার ১৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, যাঁদের মধ্যে ৫৯৮ জন তখনো বন্দী ছিলেন। ‘এনএসএ’–তে গ্রেপ্তার সবচেয়ে বেশি মধ্যপ্রদেশে, তার পরেই উত্তর প্রদেশ। দুটি রাজ্যই বিজেপি-শাসিত। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিক পঞ্জির (এনআরসি) বিরুদ্ধে যাঁরা আন্দোলন করছিলেন, তাঁদের অধিকাংশ গ্রেপ্তার এই আইনে। উত্তর প্রদেশের চিকিৎসক কাফিল খানকে ৯ মাস বন্দী রাখা হয়েছিল, দলিত নেতা ভীম আর্মির প্রধান চন্দ্রশেখর আজাদকেও ১৩০ দিন।
জম্মু-কাশ্মীরে চালু রয়েছে ‘পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট’ বা ‘পিএসএ’। ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ ও রাজ্য দ্বিখণ্ডিতকরণের পর ভূস্বর্গে যত ধরপাকড়, প্রায় সবই এই আইনে। অর্ধশতাব্দী আগে তৈরি এই আইনে বিনা বিচারে দুই বছর আটক রাখা যায়। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে জারি রয়েছে ‘আর্মড ফোর্সের স্পেশাল পাওয়ারস অ্যাক্ট’ বা ‘আফস্পা’। এই আইনে সেনাবাহিনী বিনা ওয়ারেন্টে যাকে খুশি ধরতে পারে, তল্লাশি করতে পারে, গ্রেপ্তার করতে পারে। সন্দেহভাজনকে গুলি করে মেরেও ফেলতে পারে। দমন–পীড়নের জন্য আইনের অভাব নেই। অথচ দেশদ্রোহ আইন স্থগিত রাখতে সরকারের অনীহা! এত আইন, অথচ দোষী সাব্যস্তের সংখ্যা নগণ্য। রোমিলা থাপার, তনিকা সরকার, পার্থ চট্টোপাধ্যায় বা জ্ঞানেন্দ্র পান্ডের মতো প্রবীণ ইতিহাসবিদেরা সংগত কারণেই তাই বলেছেন, বিচার ও সাজা নয়, সরকার প্রতিবাদীদের ভয় দেখিয়ে চুপ রাখতে চায়। চায় বিচিত্র সব আইনের জুজু দেখিয়ে তটস্থ রাখতে। দেশদ্রোহ আইন খারিজ হলেইবা কী? ভয়ের অন্য খাঁড়াগুলো তো ঝুলছেই! (সমাপ্ত...)
(সৌজন্যে: প্র. আ.)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct