রাষ্ট্র বিজ্ঞান কথাটির প্রথম প্রয়োগ ঘটে ১৭০১ খ্রিস্টাব্দে। রাষ্ট্র বিজ্ঞান কে ‘আবহবিদ্যা’র সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এই রাষ্ট্র বিজ্ঞান সম্পর্কে যাঁদের একটু ধারণা আছে তাঁরা সকলেই নিশ্চয়ই একথা মানবেন যে,রাষ্ট্র প্রতিটা নাগরিকের কাছে পিতৃসম। রাষ্ট্রের মস্তিষ্ক হল সরকার। তাই কোনো রাষ্ট্র নাগরিকের প্রতি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে সবার প্রথমে সেই ব্যর্থতার দায়ভার সরকারের উপরে এসে যে বর্তাবে সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না। নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের কর্তব্য নিয়ে লিখেছেন সনাতন পাল। আজ শেষ কিস্তি।
কোভিড শুধু জাতীয় বিপর্যয়ই নয়- আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিপর্যয়। তাহলে কোভিডে কর্মহীন মানুষ গুলোকে বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করতে সরকার যদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে না পারে পারে, তাহল এই পরিকল্পনা কে গ্রহন করব? খবরের কাগজ খুললেই মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে যে হাতে কাজ নেই, ঘরে খাবার নেই, পেটে ভাত নেই- দিশেহারা হয়ে সপরিবারে আত্মহত্যা করেছে। এই মৃত্যুর কারণ বদলাতে সরকার যতটা চেষ্টা করে ঐ মানুষ গুলোর খাবারের জন্য যদি সরকার অর্ধেক চেষ্টা করত, তাহলে হয়তো ওঁদের আর মরতেই হত না। যদিও আত্মহত্যাকে সমর্থন করার কোনো প্রশ্নই আসে না। সরকার একদিকে শিশুর শিক্ষার অধিকার রক্ষার আইন বের করছে আর সেই সরকার নিজেই শিক্ষাকে বেসরকারিকরণের মধ্য দিয়ে গরীব ঘরের শিশুরা যাতে শিক্ষা না পায় তার ব্যবস্থা করছে! ভারত একটা খাদ্য স্বয়ম্ভর দেশ। হাজার হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য গো-ডাউনে পচে নষ্ট হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকার কি কার্যক্রম গ্রহণ করেছে? ভারতের মত সংবিধান যেখানে কার্যকর আছে সেখানে দেশের একজন নাগরিকেরও যদি অনাহারে মৃত্যু হয় তার দায় সরকার এড়িয়ে যেতে পারে না ।
সভ্যতা এগিয়েছে। প্রযুক্তিরও অগ্রগতি ঘটেছে। যার কারণে আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবিকার তাগিদে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতোদিন ধরে গ্রামে যাঁরা খেত মজুরের কাজ করতেন, তাঁরা আজকে অনেকেই শহরে এসে দিন মজুরে পরিণত হয়েছেন। তার প্রধান কারণ হলো গ্রামে যে সমস্ত কৃষক রয়েছেন তাঁরা ফসলের ন্যায্য মূল্যের অভাবে ক্ষেত মজুরদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিতে পারেন না । আবার সিলভার, স্টিলের বাসন পত্র আবিষ্কার এবং পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করার কারণে কুম্ভকার-রা জীবিকা সংকটে পড়েছেন। হস্তচালিত তাঁতের চেয়ে যন্ত্রে কাপড় তৈরী করা বেড়েছে। তাই তাঁতিদের দরজা তেও অভাব আজ কড়া নাড়ছে। প্ল্যাস্টিকের মাদুরের ব্যবহারের বেড়েছে তাই মাদুর শিল্পীরা জীবিকা সংকটে পড়েছেন। কিন্তু পেট তো আর থেমে থাকবে না। তাই বড় অংশের ক্ষেতমজুর, কুম্ভকার,তাঁতিরা জীবিকার তাগিদে পেটের দায়ে কেউ হয়েছেন রাজমিস্ত্রি, কেউ হয়েছেন দোকান কর্মচারী। কেউ হয়েছেন রিক্সা চালক, কেউ বা ভ্যান চালক। কিন্তু চারিদিকে বেকারেত্বর এতো হাহা কার যে, সেখানেও চলছে প্রতিযোগিতা। এসব কাজ করে যা আয় করছেন,তাতেও এই দ্রব্যমূল্যের বাজারে সংসার চালানো কুশকিল। তাই এঁদের মধ্যে অনেকেই আজকে পিতৃভূমি ছাড়া। ভিন্ন রাজ্যে গিয়ে পরিযায়ী খেতাব পেয়েছেন। কিন্তু তাতেও কি সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান হয়েছে? হয়নি। বাংলায় জমি-নীতির কারণে তেমন ভারি শিল্প গড়ে উঠতে পারছে না, তাই শিল্পায়নের পাশাপাশি নগরায়নও বাধা পাচ্ছে। আবার যে রাজ্য গুলিতে কারখানা গড়ে উঠেছে সেখানেও কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শুধু মাত্র উৎপাদন সামগ্রীর চাহিদা না থাকার কারণে। উৎপাদন সামগ্রীর চাহিদা তখনই কমে যায়, যখন মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়। আর ক্রয় ক্ষমতা তখনই কমে যায় যখন দেশের বেশির ভাগ মানুষের রোজগার কমে যায়। এখন প্রশ্ন হলো এই ব্যাপক অংশের মানুষের কি হবে? তাঁরা কাজ কোথায় পাবেন? কি করে তাদের পেট চলবে? ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করার খরচই বা কে জোগাবে? প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে সমাজে মানুষের যেমন অনেক কিছুরই সুবিধা হয়েছে, তেমনি কিছু সমস্যারও সৃষ্টি হচ্ছে। এখন বিষয় হলো কিছু অংশের মানুষের সমস্যা হতে পারে বলে তো আর বৃহৎ অংশের মানুষকে সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করা যাবে না। বরং প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে যে সমস্ত মানুষের কাজ চলে গেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাঁদের জীবিকা নির্ধারণের পরিকল্পনা রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করা দরকার। আর তা যদি না করা হয়, তাহলে অনাহার অর্ধাহারে মানুষের মৃত্যু বাড়বে। কিন্তু সরকারের এই সংকটাপন্ন মানুষদের জন্য কি ভাবনা রয়েছে? মাসে ৫০০ টাকা পাবার লক্ষ্মীর ভান্ডার? মাসে ৫০০ টাকা একটা পরিবারের কয় দিন চলবে ? লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্প জন-মোহিনী রাজনীতির একটা অঙ্গ হতে পারে। এই ধরণের অনুদানের সস্তা রাজনীতি দিয়ে বাড়ীর কাজের লোক থেকে মালকিন কে এক লাইনে দাঁড় করানো গেলেও, কিন্তু জীবিকার সংকট থেকে কখনই মুক্তি দিতে পারবে না। আবার পুরোনো জীবিকা থেকে উৎখাত মানুষ গুলো হয়তো আর আগের জীবিকায় ফিরতেও পারবেন না। তাই এঁদের ক্ষেত্রে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা ছাড়া সরকারের কাছে বিকল্প আর কোনো পথ খোলা নেই। এই মানুষ গুলোকে প্রজা না ভেবে নাগরিক ভেবে তাঁদের সমস্যা সমাধান করাটাই হবে রাষ্ট্রের কর্তব্য। (সমাপ্ত...)
(লেখক শিক্ষক এবং বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct