অচেনা দৃষ্টি
শাহানাজ পারভীন
_______________
প্লিজ,একটু সরে দাঁড়ান তো দাদা! বিনয়ের সাথে কয়েকবার বলল নাজ। লোকটা কোনো কেয়ারই করছে না। নাজ এবার রেগে বলল,গায়ের উপর এভাবে ঢলে পড়ছেন কেন? সোজা হয়ে দাঁড়ান তো। শুনতে পারছেন না? লোকটা নড়ে চড়ে দাঁড়ালো। একটু পরে আবারও একই কাজ করলো। প্রথমে নাজ ভাবছিল প্রচন্ড ভীড়ে হয়তো এ রকম হচ্ছে। পরে খুবই গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখলো, আসলে তা নয়। মাঝে মাঝে লোকটা ইচ্ছে করেই নাজের পিঠে টাচ লাগানোর চেষ্টা করছে। নাজ লোকটি মুখের দিকে তাকালেই,লোকটি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকছে। এমন ভাব করছে,যেন ভাজা মাছটি উল্টিয়ে খেতে জানে না। নাজ এবার খুবই সতর্কতার সাথে থাকলো।লোকটি আবার যখন একই কাজ করলো নাজ বলল,দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা! নাজ পায়ের হিল জুতা দিয়ে লোকটার পায়ের আঙুলের উপর চাপ দিয়ে দাঁড়ালো।লোকটি মাগো বলে সরে দাঁড়ালো। নাজ তখন একটা সিটের পাশে জায়গা করে নিলো।তার সামনের সিটে এক ভদ্রলোক বসে ছিলেন। তিনি নাজকে বললেন,হ্যালো ম্যাম,আপনি এখানে এসে দাঁড়ান।উনি সামনের স্টেশনে নামবেন।লোকটির কথা মতো দাঁড়িয়ে,নাজ জানালার পাশে একটা সিট পেয়ে গেলো।লোকটির প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়ে সিটে বসে পড়লো। লোকটা অনেক সুদর্শন।।বয়স তেমন বোঝা যাচ্ছে না। মাথাভর্তি স্লিকী চুল। একটু লম্বা লম্বা চুল। মাঝে মাঝে বাতাসে সিল্কী চুলগুলো কপালটা ঢেকে দিচ্ছে। হ্যান্ডসাম,সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। অপূর্ব মায়াভরা চোখ।এমন সময় এক বাদামওয়ালা এলো। লোকটি দুই প্যাকেট বাদাম কিনলো। এক প্যাকেট নাজের দিকে বাড়িয়ে বললেন, প্লিজ বাদাম খান।। ভয় নেই আমি খারাপ মানুষ নই। নাজ বাদামের প্যাকেটটি হাতে নিয়ে জানালার পাশে বসে প্রকৃতি দেখছে। লোকটি আবার বললেন, কী হলো? বাদামটা খাচ্ছেন না কেন? এমনভাবে আন্তরিকতার সাথে কথা বললেন, যেন নাজ কত দিনের চেনা।
লোকটি বললেন আপনার নামটি কিন্তু জানা হলো না।আমার নাম নাজ।আপনার?অরুণ। কি করেন আপনি? ইঞ্জিনিয়ার।অফিসে যাচ্ছেন বুঝি! না, ঘুরতে যাচ্ছি। আজ রবিবার।সাপ্তাহিক ছুটি।প্রতি রবিবার আমি এখানে ঘুরতে আসি। লোকটি বললেন। কোথায় নামবেন আপনি? নাজকে প্রশ্ন করলেন।চাকদহ,নাজ উত্তর দিলো ।লোকটি বললেন,এখনও ৪ টা স্টেশনের পর। তারপর গুন গুন করে গান শুরু করলো। “মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম। “গান থামিয়ে অপল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো অরুণ। নাজ বলল,এভাবে কী দেখছেন?লোকটি বললেন,আপনাকে। খুব মায়াবী আপনি। আপনার মুখখানা কি মিষ্টি! পবিত্র। আপনাকে গভীরভাবে না দেখলে কেউ বুঝবে না। নাজ হেসে দিলো। অরুণ বলল, হাসলেন কেন? আমি কি হাসির কিছু বলেছি? নাজ বলল,হেসেছি আপনার পাগলামি দেখে।মাত্র এতটুকু সময়ে এত বড় সার্টিফিকেট দিলেন!শুনন, এই পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ মানুষকে চেনা।ত্রিশ বছর একই সাথে,একই ঘরে থেকেও কেউ কাউকে চিনতে পারেনা। জগতে এমন মানুষও আছে।তা হয়ত ঠিক বলেছেন।কিম্তু আমার চোখ আপনাকে চিনতে ভুল করিনি।আপনি কি কবি? নাজ জিজ্ঞেস করলো।না।তবে কবিতা,গান পছন্দ করি।নাজ অরুণের চোখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,কী মায়াবী চোখ! মনে হচ্ছে “শতজনমের প্রেম লুকিয়ে আছে ঐ চোখের গভীরতায়”। কী কালো ঘন পাঁপড়ি!মনে হচ্ছে প্রেমের সুরমা মেখেছে চোখের নীচে। লোকটি বললেন,আপনি কবিতা ভালবাসেন? যদি অনুমতি দেন তাহলে শোনাতে পারি। নাজ বলল, আমার প্রিয় ।কবিতা আমি ভীষণ ভীষণ ভালো বাসি। লোকটি জীবনান্দদাসের #বনলতাসেন# কবিতাটি শোনালেন। নাজ আরো অবাক হলো,এত সুন্দর আবৃত্তি শুনে। ইতিমধ্যে প্রায় পথ ফুরিয়ে এসেছে। লোকটি গম্তব্যে নামলো না।নাজ বলল,নামলেন না যে।উনি বললেন,আর একটু সময় থাকতে চাই, আপনার সাথে।পরের স্টেশনে নামবো,বলেই বুক পকেট থেকে একটা ছোট্ট প্যাড বের করে মোবাইল নম্বর ও ফেসবুক আইডি দিলেন।বললেন,যদিও কখনও মনে হয় তবে কল দিবেন।আর এই আইডি নম্বরে friend request দিবেন। আপনার মিষ্টি মুখখানা হৃদয়ের গহীনে এঁকে নিয়ে গেলাম।অপেক্ষায় থাকবো। বলেই লোকটি তড়িঘড়ি পালবাড়ী স্টশনে নেমে পড়লেন। ইতিমধ্যে ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠলো।। লোকটি মায়াবী চোখে নাজের দিকে তাকাতে তাকাতে হাত নাড়িয়ে বিদায় নিয়ে নেমে পড়লেন। নাজ মনে মনে বলল, অনেক না বলা কথা রেখে গেলাম আপনার দৃষ্টির গভীরে। নাজ লোকটিকে আর দেখতে পেলো না। ট্রেনটি তিন মিনিট দাঁড়ালো স্টেশনে। নাজ জানালায় মুখ বাড়িয়ে দেখলো, চারিদিকে লোকজন দৌড়াদৌড়ি করছে। একজনকে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে দাদা? ওখানে এত ভীড় কেন? লোকজন সব ছোটাছুটি করছে কেন?
একজন লোক জবাব দিলো,এক্সিডেন্ট। নাজের বুকের ভিতর ধাক্কা দিলো। আবার ট্রেন ছেড়ে দিলো। তারিখটা ছিলো ১৪ই ফেব্রুয়ারি। নাজ বাসায় ফিরলো।সারাক্ষণ সেই দৃষ্টি । সে কিছুতেই ভুলতে পারছিলো না।এ ভাবে সাতটি দিন কেটে গেলো।নাজ কাগজটি বের করলো। friend request দিতে গিয়ে দেখে profile Lock.নাজের ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেলো। profile lock করা আইডি একদম পছন্দ করেনা। এটা নীতিগতভাবে ঠিক নয়। তাই এ রকম friend request সে কখনও accept করেনা।। সে ভাবল, ফোন করে বকা দেবে। তাই সে মোবাইল নম্বরটা নিয়ে ফোন করলো। একটা মেয়ে ধরলো। নাজের গলার স্বর কাঁপছে।এক তো profile টা lock তাতে আবার একটা মেয়েকন্ঠ। রেগেমেগে কিছু না বলেই ফোন রেখে দিলো।পরোক্ষণে মেয়েটা আবার ফোন দিলো নাজের কাছে।নাজ তখন কিছুটা শান্ত। হ্যাঁ বলুন। মেয়েটি বলল,আপনি কাকে চাইছেন? নাজ বলল,অরুণকে। হ্যাঁ আমার দাদা ভাই।প্লিজ উনাকে একটু দেওয়া যাবে? মেয়েটি খানিকটা সময় চুপ করে রইলো। তার কন্ঠটা ভেজা ভেজা মনে হলো। স্বরটা যেন অস্পষ্ট ।ভারী হয়ে উঠেছে।নাজ অস্থির হয়ে উঠলো। বলুন কোথায় উনি? দেন না,প্লিজ। মেয়েটি তখন জোরে কেঁদে ফেললো। দাদাভাই আর নেই। না ফেরার দেশে চলে গেছে। নাজের গলা যেন শুকিয়ে যাচ্ছিলো। ।তারপর জিজ্ঞেস করলো,কবে? কখন? কোথায়? কিভাবে? মেয়েটি বলল,গত ১৪ ই ফেব্রুয়ারী। প্রতি রবিবার দাদা ঘুরতে যায়। সেইদিন কি কারণে দাদা পালবাড়ি স্টেশনে নামলো আমরা কেউ জানিনা। তিনটার দিকে ঐ স্টেশনে এক্সিডেন্ট হয়। তারপর সব শেষ বলেই ফুফিয়ে কেঁদে ফেললো। নাজ ভাবলো,তাহলে ঐ দিন যে এক্সিডেন্টটা ঘটেছিল,ওটা উনি ছিলেন? নাজের বুঝতে কিছুই বাকী রইল না। তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেলো। হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেলো।নাজ আকাশের দিকে তাকালো।দেখলো একজোড়া মায়াবী চোখ নাজের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে।বডড অচেনা চাহনি। অচেনা দৃষ্টি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct