সমাজের অবহেলিত, নিপীড়িত, হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে যাওয়া, আধা আধপেটা খেয়ে একশ্রেণীর মানুষ সর্বদা তাদের জীবন তথা অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে যেমন অবিরত সংগ্রাম করে চলেছে তেমনি কর্ম জীবনে সফল, প্রতিষ্ঠিত হয়েও একশ্রেণীর সৎ, নিরপেক্ষ, নির্ভীক, আদ্যোপান্ত সহজ-সরল, সাদামাটা মানুষগুলোও তাদের নীতি মতাদর্শকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিজ অস্তিত্ব রক্ষায় সংগ্রামরত। এ নিয়ে লিখেছেন সজল মজুমদার।
জীব বিবর্তনবাদের পথিকৃৎ চার্লস ডারউইন তার Origin of Species গ্রন্থে Struggle for Existence বা অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম বিষয়টি বিশদে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু উক্ত বিষয়টি এবং সংক্ষিপ্ত আলোচ্য বিষয়টির শীর্ষক বা শিরোনাম একই থাকলেও ভেতরের সারাংশ পুরোপুরি আলাদা। সমাজের অবহেলিত, নিপীড়িত, হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে যাওয়া, আধা আধপেটা খেয়ে একশ্রেণীর মানুষ সর্বদা তাদের জীবন তথা অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে যেমন অবিরত সংগ্রাম করে চলেছে তেমনি কর্ম জীবনে সফল, প্রতিষ্ঠিত হয়েও একশ্রেণীর সৎ, নিরপেক্ষ, নির্ভীক, আদ্যোপান্ত সহজ-সরল, সাদামাটা মানুষগুলোও তাদের নীতি মতাদর্শকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিজ অস্তিত্ব রক্ষায় সংগ্রামরত। হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও এমনটাও হয়তো হয়। বরেণ্য শিক্ষাবিদ ড: সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ বলেছেন “ ব্যক্তির বিকাশে পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার সুনিশ্চিত করা প্রয়োজন। কোনও ব্যক্তি যদি স্বাধীনভাবে তার অনুভূতি, ভাবনা, মত প্রকাশ করতে না পারে তবে তার মন এবং আত্মিক শক্তির বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। এবং তা সেই ব্যক্তি এবং সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে”। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। বৃহত্তর সমাজের সকলের মধ্যেই মানুষকে বসবাস করতে হয়। এই সকলের মধ্যে বসবাস করতে গিয়ে ভালো ও মন্দ মানুষ এবং সুন্দর ও তিক্ত অভিজ্ঞতার সাক্ষী নানা সময়ে হতে হয়। মূলত বিভিন্ন ধরনের কর্মক্ষেত্রে এবং সমাজে চলার ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষ তাদের আত্ম দাম্ভিকতা, ইগো, অহমিকা, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব, দুর্বৃত্তায়ন পরিত্যাগ করে যদি হৃদয়ের দ্বার উন্মোচন করে, তাহলে কিন্তু সকল কর্মক্ষেত্র তথা সমাজ জীবন মধুর ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। এর ফলে কাজের একাগ্রতাও বাড়বে। মোদ্দা কথা, মানসিক তৃপ্তি না থাকলে কাজের পরিপূর্ণতা আসে না। অন্যায় বা অবিচারের বিরুদ্ধে ন্যায্য ও যুক্তিসংগত মুলক প্রতিবাদ করলে অনেক সময়ই প্রতিবাদকারী কেই পিছু হটতে হয়। প্রতিবাদের ভাষা কোথাও যেন হারিয়ে যায়!! যার ফলে দেখা যায় কর্মক্ষেত্র একেবারে একপেশে হয়ে যায়, একমুখীন ভাবে কাজকর্ম চলতে থাকে। কাজে সুফল পাওয়া যায় না, কাজ করার উদ্যমতা হারিয়ে যায়, সুনাম বা পরিচিতি অনেক ক্ষেত্রেই হারিয়ে যায়, সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবের অভাব দেখা দেয়, কর্মসংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে অন্যায় কে জেনে বুঝে সমর্থনকারী , ধামাধারী স্তবকের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। যেখানে শিক্ষা বলছে যে, প্রত্যেকটা মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার রয়েছে, স্বাধীন চিন্তা করার অধিকার রয়েছে, প্রত্যেক কেরই নেতৃত্ব দেওয়া উচিত এবং প্রত্যেকেরই উপযুক্ত চিন্তা বিচার বিবেচনা করে বাস্তবায়িত বা সেটি ফলপ্রসূ করা উচিত। এবং এটিই হয়তো গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। কর্মক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থ কে চরিতার্থ করতে গিয়ে অনেক সময়, অনেক জায়গায় আগ্রাসন নীতির মুখাপেক্ষী হতে হয়। মুখ্যত শিক্ষা ও জ্ঞান সঙ্গতিপূর্ণ বা সমানুপাতিক না হলে শিক্ষিত ব্যক্তির কাছে ন্যায় ও অন্যায়ের সীমারেখা কিন্তু একটি রেখাতেই অবস্থান করবে। তবে সময় কাউকে ক্ষমা করেনা, এবং মগজও বসে থাকেনা। সময়কে সু কাজে লাগাতে না পারলে কু কাজ করবেই, ঠিক তেমনই মগজ শুভ চিন্তার অবকাশ না পেলে অশুভ চিন্তা করবেই। আমরাই পারি সময় ও মগজকে সুসংস্কৃত করে সু কাজে ব্যবহার করতে। তাই এক কথায় সকল মানুষের কর্মস্থলে অশান্তির বীজ বপন হওয়ার পরিবর্তে তা শান্তির স্থলে পরিণত হওয়াই কাম্য ও আবশ্যিক। নচেৎ, জীবনে সফল, প্রতিষ্ঠিত হয়েও এক অন্য ধরনের, অন্যমাত্রার নিজ অস্তিত্ব রক্ষায় সংগ্রামের এই ধারা আগামীতেও বজায় থাকতে পারে, যা কখনোই কাম্য নয়। সবশেষে কবি শ্রীজাতের তফাৎ কবিতার শেষ চারলাইন উল্লেখ করতেই হয়, “ মানুষ থেকে মানুষ আসে, বিরুদ্ধতার ভিড় বাড়ায়, আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ, তফাৎ শুধু শিরদাঁড়ায়”।
(লেখক শিক্ষক ও বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct