ভোজনপ্রিয় রবি ঠাকুর
এস ডি সুব্রত (কবি ও প্রাবন্ধিক)
_____________________________
ছোটবেলাতেই প্রাতরাশ নিয়ে এক কবিতা লেখে মাত করে দিয়েছিলেন কবিগুরু ।
“আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতেই কদলী দলি।
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতেই হাপুস-হুপুস শব্দ।
চারিদিক নিঃশব্দ। পিঁপড়ে কান্দিয়া যায় পাতে।”
বার বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার তার বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেশভ্রমণে বের হন। তারপর বিভিন্ন সময়ে সারা জীবন ধরে বহু দেশ ঘুরেছেন। প্রতিটি দেশের ভালো লাগা খাবারগুলো ঠাকুরবাড়ির হেঁসেলে চালু করে দিতেন কবিগুরু। একটা সময় ছিল যখন ঠাকুরবাড়িতে সবাইকে নিয়ে কবিগুরু একসঙ্গে খেতে বসতেন। কবি জাপানি চা পছন্দ করতেন । তিনি জাপানে গেলে প্রায় প্রতিদিনই তার জন্য ‘টি সেরিমনি’র আয়োজন করতেন গুণমুগ্ধরা। ১৯১৩ কবি নোবেল পুরস্কার পেলেন। এর আগের বছর ১৯১২ সালে লন্ডনে ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ওই দিনের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল ইন্ডিয়ান সোসাইটি, লন্ডন। সেদিনের খাদ্য তালিকা হয়েছিল কবির পছন্দে। এই খাবারের তালিকায় ছিল , গ্রিন ভেজিটেবল স্যুপ, ক্রিম অব টমেটো স্যুপ, স্যামন ইন হল্যান্ডেন সস এ্যান্ড কিউকামবার, প্রি সলটেড ল্যাম্ব উইথ গ্রিন ভেজিটেবল, রোস্ট চিকেন, ফেঞ্চ ফ্রাই, গ্রিন স্যালাড ও আইসক্রিম। বাইরে এই ধরনের খাবার খেলেও বাড়িতে তিনি কম তেল-মশলাযুক্ত খাবার খেতেন।কবির স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর রান্না ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে খুব জনপ্রিয় ছিল। তার হাতের রান্না খেতে সবাই খুব পছন্দ করতেন, বিশেষত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি নাকি টকের সঙ্গে ঝাল মিশিয়ে বেশ নতুন নতুন পদ তৈরি করতেন। কবি দেশি খাবারের মধ্যে পছন্দ করতেন কাঁচা ইলিশের ঝোল, চিতল মাছ আর চালতা দিয়ে মুগের ডাল এবং নারকেল চিংড়ি। এছাড়া তিনি কাবাব খেতে খুব পছন্দ করতেন। এসবের মধ্যে ছিল শ্রুতি মিঠা কাবাব, হিন্দুস্তানি তুর্কি কাবাব, চিকেন কাবাব নোসি। কলকাতার ঠাকুরবাড়িতে এখনও সযত্নে রক্ষিত আছে মৃণালিনী দেবীর রান্নাঘর। সেখানে রয়েছে তার ব্যবহৃত একটি চুলা, আর বেশ কিছু চিনামাটির বাসন। কবি কাঁচা আম খেতে ভালবাসতেন। আচারও খেতেন। কাদম্বরী দেবী কবিকে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁচা আম এনে দিতেন।
এখানেই শেষ নয়, কবিগুরু ছিলেন পানের ভক্ত। তার নাতজামাই কৃষ্ণ কৃপালিনী তাঁকে একটি সুদৃশ্য পানদানি বা ডাবর উপহার দিয়েছিলেন, যা আজও ঠকুরবাড়িতে রক্ষিত আছে। ঠাকুরবাড়ির রান্নায় বেশি করে মিষ্টি দেওয়ার প্রচলন ছিল। গরম মশলা, লবঙ্গ, দারুচিনি বেশি পরিমাণে ব্যবহৃত হতো। রান্নার তালিকায় প্রতিদিনই দীর্ঘ পদ থাকত। আর তাতে নিয়মিত অবশ্যই থাকত সুক্তো আর দইমাছ। দেশে ও বিদেশে নানা ধরনের খাবার খেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শেষ পাতে মিষ্টি খেতে ভালোবাসতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইঝি প্রজ্ঞা সুন্দরী দেবী খুব ভালো রান্না করতেন। তাঁর রান্না খেয়ে গুরুদেব অনেক প্রশংসা করতেন। প্রতিদিন সকালে উঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক গ্লাস নিমপাতার রস খেতেন। আশ্রমের শিক্ষক অনিল চন্দের স্ত্রী রানী চন্দ প্রায়ই রান্না করে আনতেন তাঁর জন্য। পায়েশ বা বাদামজাতীয় মিষ্টি রবীন্দ্রনাথ ভালোবাসতেন। রবীন্দ্রনাথ সারাদিনে বেশ কয়েকবার খেতেন। তিনি ভোরবেলায় খুব তাড়াতাড়ি উঠে পরতেন,তার দিনের শুরু হত এক কাপ চা অথবা কফি খেয়ে। একটু বেলা হয়ে প্রাতঃরাশে ভেজা বাদাম, মধু সহযোগে টোস্ট এবং এক কাপ দুধ। আবার মাঝে মাঝে তার ছোটবেলার প্রিয় খাবার সন্দেস, কলা দুধে ফেলে মেখে খেতেন। এর পর সকাল দশটা নাগাদ তিনি লেবুর রস খেতেন এবং মধ্যাহ্ন ভোজনে রবীন্দ্রনাথ ভাত খেতেন, তবে তিনি ভাত খুব অল্প পরিমাণে খেতেন। বিকেলে খেতেন মুড়ি ও চা। কবির রাতের খাবারে থাকত সব্জির স্যুপ কয়েকটি লুচি ও তরকারী। রবীন্দ্রনাথ দুপুরের খাবার পরিবারের সবাই মিলে ঘরের মেঝেতে বসে খেতেন কিন্তু রাতের বেলায় তিনি খেতেন ডাইনিং টেবিলে বসে। দেশী বিদেশী কোন খাবারেই তার অরুচি ছিল না। তার প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল ব্রিটিশ পদ, আপেল দিয়ে রান্না খাসীর মাংস, তুর্কী কাবাব।ত
ঠাকুর বাড়ির মেয়েরা রান্না নিয়ে প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন, নিত্য নতুন খাবারের পদ তৈরিতে তারা সব সময় ব্যস্ত থাকতেন। তারা অতি সাধারণ উপাদান ষেমন পটল ও আলুর খোসা দিয়েও সুস্বাদু পদ তৈরী করতেন । রবীন্দ্রনাথের একটি স্বভাব ছিল তিনি দেশে বিদেশে যেখানেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতেন সেখানকার মেনুকার্ড তিনি সংগ্রহ করতেন এবং সেগুলি তিনি সংরক্ষণ করে রাখতেন এই ঘটনা থেকেই রবীন্দ্রনাথের ভোজন রসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। দেশীয় খাবারের মধ্যে কৈ মাছের তরকারি, চিতল মাছের পেটি ভাজা এছাড়া ভাপা ইলিশ, ফুলকপি দিয়ে তৈরী নানান পদ ছিল রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয়। এছাড়া মিষ্টি খাবারের মধ্যে পায়েস, চন্দ্রপুলি, ক্ষীর, নারকোল দিয়ে তৈরী মিষ্টি, দই এর মালপোয়া, চিড়ের পুলি, মানকচুর জিলিপি, আমসত্ত্ব এগুলি খেতে খুব ভালবাসতেন তিনি। তবে পায়েস ও পিঠে পুলির প্রতি কবির টান ছিল বেশী। ফলের প্রতিও কবিগুরুর একটা আকর্ষণ ছিল। তিনি দুপুরের খাওয়ার আগে ফল খেতেন। যেমন পাকা পেপে, কলা, বাতাবি লেবু আমের সময় আম। রবীন্দ্রনাথের আহার সম্পর্কে বনফুল এর বর্ননা এরকম-- ‘ভৃত্য নীলমণি বেশ বড়ো একটা কাঁসার থালা এনে রবীন্দ্রনাথের সামনে রাখল। থালার ঠিক মাঝখানে একটা রুপোর বাটি উপুড় করা। আর তার চার পাশে নানা রকমের কাটা ফল গোল করে সাজানো। কাটা ফলের ফাঁকে ফাঁকে গুঁড়ো গুঁড়ো কী সব ছড়ানো। প্রাতরাশের এই অদ্ভুত সজ্জা দেখে আমি তো অবাক। বিস্ময়ের মাত্রা আরও বেড়ে গেল যখন রবীন্দ্রনাথ আস্তে করে রুপোর বাটিটা তুলে ফেললেন আর তার ভেতর থেকে ওই বাটির মাপের সাদা জমানো একটা জিনিস বেরিয়ে পড়ল। জিনিসটা কী জানতে চাইতেই রবীন্দ্রনাথ বললেন, ক্রিম। আর এগুলো নানা রকমের ফল, বাদাম, ডাল ভেজানো, খাবে তুমি? আমি খাইনি। তবে লক্ষ করেছিলাম তাঁর দীর্ঘ প্রাতরাশ। কবিগুরু মার্মালেড, গোল্ডেন সিরাপ, আদার রস, দুধ, কলা, মাখন ইত্যাদি দিয়ে আধ ঘণ্টা ধরে ছাতু মাখতেন, নিজে খেতেন, অন্যকে খাওয়াতেন। বেশ গর্ব করেই মৈত্রেয়ী দেবীকে বলেছিলেন, ‘এক সময় ভালো ছাতুমাখিয়ে বলে আমার নাম ছিল। মেজদার টেবিলে ছাতু মাখতুম মার্মালেড দিয়ে।নানা রকমের খাবার খেতে, খাবার খাওয়াতে এবং খাবার নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে ভালোবাসতেন কবিগুরু।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct