চলে গেল হিন্দুদের দোল,আসছে মুসলমানদের ঈদ।এই উৎসবগুলোতে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী কিছু ছোট ছোট ছেলে কিভাবে সম্প্রীতির বন্ধনে পরস্পরকে আলিঙ্গন করে তা’সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে শিক্ষণীয়। বিদ্বেষ আর বিশৃঙ্খলা আজ কিশোর থেকে বৃদ্ধ সবাইয়ের মানসিকতাকে যেভাবে গ্রাস করে, বিষিয়ে তুলছে, তাতে এই দৃষ্টান্ত মানুষের সামনে তুলে ধরতেই এই অভিজ্ঞতা এখনকার মানুষের সামনে অকপট তুলে ধরলেন সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়।
অনেক বছর আগের কথা, সম্ভবত সেটা ছিল ইংরেজি ১৯৮৩ সাল, চাকরি সূত্রে রয়েছি বীরভূম জেলার রামপুরহাট। সেদিন ছিল বাঙালি হিন্দুর দোল। দোলে আমার ছুটি ছিল না। সকাল থেকে টানা অনেকক্ষণ কাজ করার পরবেলা ১১ টা নাগাদ কর্মস্থল থেকে ১৫-২০ মিটার দূরে একটা দোকানে চা খেতে যাচ্ছিলাম। পথে ৮-৯ জন ১৫-১৬ বছরের ছেলে সারা গায়ে রঙ মেখে, কেউ হাতে এক ঠোঙা গুড়ো রঙ ,কেউ জলে গোলা রঙের পিচকারি নিয়ে আমার কাছে এসে যথেষ্ট বিনয় ও ছেলেমানুষের স্বরে বলল, “কাকু,একটু রঙ দেব”? জন্মাবধি,কলকাতা উত্তর শহরতলীতে কাটিয়েছি। সেখানে দোলের দিন এইভাবে ৮-৯ টা ছেলের সাথে দেখা হলে,আচমকাইকোনও গোলা রঙ গায়ে ছুঁড়ে দিত আর কোনও কালো,লাল বা বেগুনী রঙ জামায় বা মুখে অথবা দু’জায়গাতেই ঘষে দিত,কোনও অনুমতির প্রয়োজনই মনে করত না। শুধু কলকাতা শহরতলিই নয়, দেশের অজস্র জায়গাতেই এই ধারা। তাই এখানকার এই বিপরীত দৃশ্য দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
ঘটনার পরবর্তী পর্যায়টা ছিল আরও সুন্দর। চলে যাওয়ার পথে ওদের একজন অন্য আরেকজনকে বলল,” সাইফুল্লা, তোর কোন বন্ধুর বাড়ি যাবি বলেছিলি “? সাইফুল্লা নামটা শুনে,ছেলেগুলোকে ডেকে ওদের মধ্যে কে সাইফুল্লা জানতে চাইলাম। সেটা জানার পর ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, “ তোর নাম সাইফুল্লা ”? সে বলল, “ হ্যাঁ কাকু, আমার নাম সাইফুল্লা আর আমার ভাইয়ের নাম শহীদুল্লা ”। কলকাতা হলে এটা ইয়ার্কি বা ফাজলামি হতে পারত কিন্তু এই মফস্বল এলাকায় এতদিন কাটিয়ে বুঝেছি যে, এখানকার ছোট ছেলেমেয়েরা কাকা স্থানীয় কারুর সাথে এইরকম ইয়ার্কি বা ফাজলামি করে না। ছেলেটিকে বললাম,“ তোদের এই দলে ক’জন মুসলিম ছেলে আছিস “? সাইফুল্লা বলল, ‘আমরা দুজন মুসলমান আর বাকি ৬ জন হিন্দু। আমরা প্রতি বছর দোলেই এই ক’জন বন্ধু একসাথে ঘুরি। তাছাড়া, আমরা এই দুই বন্ধু নিয়মিত নামায পড়ি, রমযান মাসে রোযাও রাখি। আমার দাদাজি বলত, নিজের ধর্ম নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে হয় পাশাপশি অন্য ধর্মের আচারকেও শ্রদ্ধা করতে হয়। শুধু দোল নয়, দুর্গাপূজো, কালীপূজোর সময়ও আমরা একসঙ্গে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখি, আনন্দ করি। বিজয়াদশমীর পর এক সাথেই নানা বাড়িতে যাই। আর ঈদের দিনও এইরকম এক সাথেই বাড়ি বাড়ি ঘুরে সিমুই খাই’। মুগ্ধ হয়ে গেলাম ছোট্টছেলেটির মুখে দার্শনিকতুল্য কথা শুনে। এই ঘটনার পর সুদীর্ঘ ৩৯ বছর পার হয়ে গিয়েছে। সেদিনের সেই ছেলেগুলো নিশ্চয় আজ বার্ধক্যে উপনীত। আজকের ১৫-১৬ বছরের কিশোররা সম্পূর্ণ নতুন প্রজন্ম। চারিদিকে সামাজিক অবক্ষয়ের যুগে রামপুরহাট অঞ্চলের এখনকার ছোট ছোট ছেলেদের সেইরকম সুন্দর মানসিকতা আগের মত সুন্দর আছে কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু সেদিনের সেই স্মৃতি আজও আমার মনে অমলিন হয়ে গেঁথে রয়েছে। ছোট ছোট ছেলেগুলোর বিনয়, নম্রতা, শৃঙ্খলা আর বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের পাশাপাশি ধর্মীয় বিভেদকে শত হাত দূরে সরিয়ে রাখা নিবিড় বন্ধুত্বের মেলবন্ধনের এ এক অপূর্ব নিদর্শন, যা সারা দেশের কাছেই শিক্ষণীয়। বিদ্বেষ আর বিশৃঙ্খলা আজ কিশোর থেকে বৃদ্ধ সবাইয়ের মানসিকতাকে যেভাবে গ্রাস করে, বিষিয়ে তুলছে, তাতে এই দৃষ্টান্ত মানুষের সামনে তুলে ধরতেই আমার এই অভিজ্ঞতা এখনকার মানুষের সামনে তুলে ধরলাম।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct