তাল পাখার ভালোবাসা
শাহানাজ পারভীন
________________
দরজায় কড়া নাড়লো মিতা।সাথে ঝর্ণা আর রুবি। কী রে, কী হলো তোর! দরজাটা খোল। দরজা খুলতেই ওদের চোখ ছানাবড়া। রুবী আবেগী হয়ে বলল,এই মিনা, তোকে তো চেনাই যাচ্ছে না।বাব্বা, কী অপরূপ লাগছে তোকে! যেন অপসারী। মিতা গেয়ে উঠলো, অপরূপা তুমি বড় অপরূপা। মিনু অভিমানী সুরে বলল,কী হচ্ছে কী এসব! ভাল হচ্ছে না কিন্তু। খুব ফাজলামি করছিস তোরা। সত্যিই অপরূপ লাগছিলো মিনুকে।সাদা শাড়ি লাল পাড়, তার সাথে টকটকে লাল ব্লাউজ, হাতে লাল রেশমী চুড়ি,আলতা মাখা পা,হালকা মেকাপ করেছে খোঁপায় বেলীফুলের মালা,আর কপালে লাল টিপ।লাল টিপটা কপালের উপর জ্বল জ্বল করে জ্বলছে।মনে হচ্ছে নববর্ষের উদিত নব সূর্য। সব মিলে মিনুকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।বৈশাখী সাজে সেজেছে ওরা। মিনুর কাকে কলস,রুবীর হাতে কুলা,মিতার হাতে সিঁকার ভিতর একটা হাঁড়ি আর ঝর্ণার হাতে ছোট্ট ডালা। হরেক রকম ফুল দিয়ে সাজানো।মনে হচ্ছে এক ঝাঁক ফুলপরী। ওরা এক সঙ্গে বেরিয়ে পড়লো কলেজের উদ্দেশ্যে। কলেজে পৌঁছে ওরা আরো হত হতভম্ব হয়ে গেলো। ও মা এ কী।ছেলেরাও বৈশাখী সাজে সেজেছে। কেউ চাষী,কেউ জেলে,কেউ কুমোর। দুইজন আবার পালকী কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কেউ কেউ আবার পাঞ্জাবি পাজামা পরে এসেছে। কেউ কেউ বউ -বর সেজেছে।।কলেজের পুরা মাঠটা জমজমাট। খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। পান্তা ইলিশ,সাথে আলুভর্তা,ঘোটা ডাল, লঙ্কা ও পিঁয়াজ। কলেজের একপাশে ছোট্ট ছোট্ট পিঠাপুলির দোকান। রুবী দৌড়ে এসে বলল, এই দ্যাখ দ্যাখ সাজ্জাদ কে কী সুন্দর লাগছে! লাল খয়েরি পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামা পরেছে।পাঞ্জাবিতে ঢাক-ঢোলের ছবি আঁকা। কপাল ঢাকা বৈশাখের ফেস্টুন দিয়ে।মিনু তাকাতেই সাজ্জাদের চোখে চোখ পড়লো। সাজ্জাদ ও অপলক দৃষ্টিতে মিনুকে দেখছিল।মিনু আস্তে আস্তে চোখটা নামিয়ে নিয়ে দ্রুত ওখান থেকে সরে দাঁড়ালো সাজ্জাদ ও মিনুর বাড়ী একই গ্রামে।দু,জন একই কলেজে পড়ে।তবে সাবজেক্ট আলাদা।সাজ্জাদ ফোর্থ ইয়ারে। মিনু অনার্স সেকেন্ড ইয়ার। সেই মাধ্যমিক থেকেই সে মিনুকে ভালবাসে। মিনুও তাকে পছন্দ করে কিন্তুু এত বছর পরও কেউ কাউকে বলতে পারিনি। আর না বলার কারণও ছিলো। সাজ্জাদ ও মিনুর পরিবারের মধ্যে বিশাল দ্বন্দ্ব চলে আসছে অনেক বছর ধরে।জমি নিয়ে তাদের গলোযোগ।এই কারনে ভয়ে কেউ কাউকে বলতে পারিনি। একবার সাজ্জাদ মেলা থেকে একটা পুতুল কিনে দিয়েছিল মিনুকে।মিনুর বাবা জানতে পেরে মিনুকে থাপ্পড় মেরেছিল। সেই থেকে সাজ্জাদকে দেখলে মিনু মাথা নীচু করে চলে যায়। সাজ্জাদও কিছু বলেনা। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে।এইবার সে মিনুকে দু’চোখ ভরে দেখলো। মিনুও গোপনে গোপনে সাজ্জাদকে প্রাণ ভরে দেখলো।যাতে ওকে কেউ না দেখতে পারে। সাজ্জাদকে দেখার পর মিনুর বুকের ভিতর ঝড় বয়ে গেলো।কোনো কিছুতেই স্থির থাকতে পারলো না। সাজ্জাদেরও একই অবস্থা। কী করবে ভেবে উঠতে পারছিলো না।একবার সাজ্জাদ ভাবলো, চেয়ারম্যান ও মেম্বার চাচাদের দিয়ে গণ্ডগোলটা মিটিয়ে নেবে কিন্তু শত চেষ্টা করেও মিনুর বাবাকে সোজা করা গেলো না।সে একই রকম থেকে গেলো।
এদিকে মিনুর বাবা মিনুর বিয়ের জন্য তোড়জোড় শুরু করলো।সাজ্জাদ গ্রামের লোক ধরে বিয়েটা বন্ধ করার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। বড় ঘর থেকে দেখতে আসাই মিনুর বাবা আর পিছপা হলোনা।ছেলে সম্পর্কে ভালো করে খোঁজ খবর না নিয়ে তড়িঘড়ি বিয়ে ঠিক করলো।সাজ্জাদ অঝোরে কাঁদতে থাকে। সে মেলা থেকে একটা ভাঁজ করা তাল পাখা কিনে এনেছিলো মিনুর জন্য। পাখার প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে সে না বলার কথা গুলো লিখে পাঠাই। অতি গোপনে মিনুর কাছে পৌঁছে দেই।পাখাটা পেয়ে মিনু গভীর রাতে চুরি করে পড়তে থাকে।তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে নোনো জল পড়তে থাকে। সে জল কিছুতেই নিবৃত্তি করতে পারেনা। মিনু বুকের সাথে পাখাটা চেপে ধরে কেঁদে বলে, আমিও যে তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি সাজ্জাদ ভাই।কিম্তু আমার করার কিছু নেই।আমার হাত-পা শিকল দিয়ে বাঁধা,এই বলে মিনু কাঁদতে থাকে। সে পাখাটা অতি গোপনীয় জায়গায় লুকিয়ে রাখে। খুব ধুমধামের সাথে মিনুর বিয়ে হয়ে যায় বাবার দেখা পাত্রের সাথে।মিনুকে বিয়ে করে নিয়ে চলে আসে ছেলে পক্ষ। মিনু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।বার বার সাজ্জাদের মুখখানা ভাসতে থাকে তার চোখে। মিনুকে নিয়ে এসে বর কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়। তারপর অনেক রাত্রে বাড়ী ফেরে। খুবই মনোগ্রাহী করে সাজানো হয়েছে মিনুর বাসর।মিনুর বর ঘরে ঢুকতেই মুখ থেকে একটা গন্ধ আসে।মিনু আৎকে ওঠে।মিনুর বুঝতে আর কিছুই বাকী থাকেনা। কিছুদিন যেতে না যেতেই ওদের ভিতর ঝগড়া শুরু হয়।মাঝে মাঝে তার স্বামী রাত্রে বাড়ী ফেরে না।।জিজ্ঞেস করলেই ঝগড়া শুরু হয়।আস্তে আস্তে এটা নিত্য দিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।সাজ্জাদ সম্পর্কে নানা ধরনের বাজে কথা মিনুর কানে আসতে থাকে। সাজ্জাদ এখন মিনুর গায়ে হাত উঠাতেও লজ্জাবোধ করে না।
মিনুর বাবার প্রতি বুকভরা অভিমান হয়। তাই সে বাবাকে এ সব কিছুই বলেনা।দিনে দিনে সে নির্যাতন সহ্য করতে থাকে।বাবার ভুলের প্রায়চিত্ত সে এভাবেই করতে থাকে।একসময় খুবই অসহ্য হয়ে ওঠে। আর মানতে পারেনা।সে সিদ্ধান্ত নেই সুইসাইড করবে।। বাবার প্রতি রাগ করে অনেক দুরে চলে যেতে চায়। তারপর সে এক প্রতিবেশীকে দিয়ে ভাঁজ করা আর একটা তাল পাখা কেনে।জীবনের সব কথা সে সেদিন সাজ্জাদকে লেখে। সাজ্জাদের দেওয়া তালপাখাটা গোপনে বের করে আবার পড়তে থাকে।শেষের লাইনগুলোতে তার চোখ আটকে যায়।লেখা ছিলো “ মিনু জীবনে যদি কখনও বিপর্জয় নেমে আসে তবে নিজেকে হারানোর চেষ্টা করবে না। জীবনকে ভালো বাসতে শিখবে। তুমি নিজে যদি নিজের জীবনকে ভালবাসতে না পারো তাহলে অন্যরা কি করে ভালবাসবে তোমায় বলো। মনে রেখো, তোমার আত্মার ভিতরে আমার বসবাস।তুমি যেমনটি রাখবে, আমি তেমনটি থাকবো।তোমার নিঃশ্বাসে আমার নিঃশ্বাস বহে।যদি কখনও হারিয়ে যাও সেদিন আমিও হারিয়ে যাবো।জীবন মানে পরাজয় নয়।জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র যুদ্ধ ক্ষেত্র।তাই যে কোনো পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করতে হবে। আমি যে তোমার মধ্যেই বেঁচে থাকতে চাই মিনু।প্লিজ আমাকে কখনও মেরে ফেলবে না। আমি তোমার চোখেই আকাশ দেখতে চাই। মিনু বার বার লাইনগুলো পড়তে থাকে। আবারও তালপাখাটা বুকের সাথে চেপে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেললো। আমাকে মাফ করো সাজ্জাদ। আমি ভুল সিধান্ত নিতে যাচ্ছিলাম।আর কখনও এমন করবোনা সাজ্জাদ। তুমি আমাকে বাঁচার পথ দেখালে। পাখাটাকে অনেকক্ষণ আদর করলো,সারা পাখায় হাতের পরশ দিতে লাগলো।চুম্বন করলো।আবারও বুকের সাথে পাখাটা চেপে ধরে বলল,আমি তোমাকে কখনও হারাতে দেবো না সাজ্জাদ ভাই।তুমি এইভাবেই আমার ভিতর বেঁচে থাকবে।।তারপর পাখাটা নিয়ে আস্তে আস্তে করে বাতাস নিতে লাগলো।মিনুর সারা শরীর বাতাসের পরশে শীতল হতে লাগলো।। বাতাস নিতে নিতে বুকের উপর পাখাটা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো।
-------------------------------------------------------------------------------------------------
মনের ক্যানভাসে (সনাতন পাল)
শিক্ষক এবং বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক
______________________
আমরা এই পৃথিবীতে জীবিত আছি এটাই আশ্চর্য। হঠাৎ করেই কখন কাকে চলে যেতে হবে, তা কেউ জানি না। কিন্তু চলে যে যেতে হবে সেটা সকলেই নিশ্চিত। বাড়ীতে অতিথি এলে বেশির ভাগ সময়েই খবর দিয়ে আসেন। কিন্তু এখানে যার কথা বলা হচ্ছে, সে কখন আসবে তা সকলেরই অজানা। হয়তো বা কাক ভোরে কিংবা গোধূলি বেলায় কখনও বা ঘুমের মধ্যে হঠাৎ করেই এসে উপস্থিত হবে। এই আগমনের ক্ষণ কখনই কোনো জ্যোতিষীর পক্ষেও যে বলা সম্ভব নয়, এটা নির্ভেজাল সত্যি কথা। কিন্তু এই অমোঘ নিয়তির আগমনের ক্ষণ জানবার জন্য আমাদের সকলের অনন্ত জিজ্ঞাসা রয়েছে মনের ক্যানভাসে। তাই তো অনেকেই জ্যোতিষীকে গিয়ে বলেন- “দেখুন তো, আমার আয়ু কতদিন?” সকলের মধ্যে কেমন যেন একটা থেকে যাওয়ার আগ্রহ কাজ করে। হয়তো আমি আপনি কেউ তার বাইরে নই। কিন্তু কেন সেই আগ্রহ? এই প্রশ্নের উত্তর সকলের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হলেও বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই হয়তো একটা সাধারণ উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়। সেই সাধারণ উত্তরটা হলো ‘ইচ্ছে ‘। কিন্তু কি সেই ইচ্ছে? কোথা থেকেই বা এই ইচ্ছের জন্ম? মানুষ জীবিত থাকাকালীন সময়ে তাঁর ইচ্ছের কখনই মৃত্যু হয় না। যাঁরা সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ রয়েছেন, তাঁরা সকলেই নানা বিধ বিষয়ে ভাবনা করেন । ভাবনা করাই মনের স্বাভাবিক প্রবণতা। কোনো কিছুতেই যেন ভাবনার কোনো বিরাম নেই- সে অবিরাম। এই ভাবনা কারো নির্দেশে নয়, নিজে থেকেই মানুষের মনে আশ্রয় নেয়। কিন্তু কি সেই ভাবনার বিষয় বস্তু, সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে ব্যক্তির রুচি, শিক্ষা, মানসিক প্রবৃত্তি, চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনা, স্থান, কাল এবং পাত্রের উপরে। কিন্তু মানুষের মনে কিছু কিছু সময় এমন ভাবনার সঞ্চার হয়, সেটা অনেকেই প্রকাশ করতে পারেন না। স্বাধীন ভাবনার পায়ে সামাজিকতা এবং সংস্কার নামক বেড়ি পরানো হয়। সমাজ যেটা অনুমোদন করে আমরা শুধুমাত্র সেটুকুই প্রকাশ করি। এটাই হয়তো সংস্কার। কিন্তু যে ভাবনাটা নানা কারণে প্রকাশ করতে পারি না সেটা কখনও মানসিক ভাবে সুখ প্রদান করে আবার কখনও মানুষকে অধিক পীড়া প্রদান করে। তখন সে এমন একজন বন্ধুর সন্ধান করেন, যাঁকে মনের সমস্ত ভাবনাই ব্যক্ত করে হাল্কা হতে পারেন। এমন মনের মানুষের অর্থাৎ বন্ধুর সন্ধান অনেকেই পান আবার অনেকেই পান না। কিন্তু কাকে বলে সেই বন্ধু? বন্ধু মানে তো সে কথার কথা নয়। রূপ কথার ঘোড়ায় চেপে আসা কোনো রাজকুমার বা সাত সাগের পাড়ে থাকা কোনো রাজকুমারীও নয়। বন্ধু মানে, যাঁকে মনের সব কথা বিশ্বাস করে বলা যায়। বন্ধু মানে, যে আপনার-আমার মনে ব্যথা, কষ্ট, জ্বালা যন্ত্রণা অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পারবে। বন্ধু মানে, যে আপনার মনের খোরাক জোগাবে। বন্ধু তাঁকেই ভাবা যায়, আপনার- আমার কষ্টে যাঁর চোখে অকৃত্রিম ভাবে জল আসে। বন্ধু তাঁকেই বলা চলে, যাঁর ভালোবাসা ফুলের গন্ধ হয়ে আপনাকে জড়িয়ে ধরে। বন্ধু তো সেই, যে আপনার মনে ভরসা জোগায়, ভুল গুলি সহজ সরল ভাবে অত্যন্ত আন্তরিক ভাবে ধরিয়ে দেয়- যাঁর মধ্যে আঘাত করার কোনো প্রবৃত্তিই লক্ষ্য করা যায় না। আঘাত করা আর সংশোধন করার চেষ্টা করা দুটো ভিন্ন বিষয়। যাঁকে সংশোধনের জন্য তাঁর বন্ধু বলবেন, সে কথায় যাতে তিনি আঘাত না পান সেটা কেবল তাঁর নিজস্ব মানসিক প্রবৃত্তির উপরেই নির্ভর করে না- যে বলবে তাঁরও সদিচ্ছা, আন্তরিকতা এবং শব্দ বন্ধ প্রয়োগের উপরে নির্ভর করে। এই বোধ আমাদের অনেকেরই না থাকার কারণে কখনও কখনও কারো বন্ধুর মন অধিক পীড়িত হয়। সেখান থেকে অনেক সময় সম্পর্কের যেমন অবনতি ঘটে তেমনি ঐ ব্যক্তি সংশোধন হবার পরিবর্তে আরও মন্দ দিকে ধাবিত হন। যার ফলে সমাজে আরও একজন মন্দ লোকের জন্ম হয়। কিন্তু এর দায় কার? যে মন্দ দিকে ধাবিত হলো শুধু তাঁরই! নাকি উল্টো দিকে যিনি ছিলেন তাঁরও? আজকের দিনে কঠিন হলেও এই নির্ণয় আমাদের করতে হবে।
আবার এটাও ঠিক যে আমরা অধিকাংশ মানুষই পরিজনের জন্য বাঁচি। কিন্তু এটাও ঠিক যে পরিজনরা সব সময় প্রিয়জন হন না। ফলে মানসিক অতৃপ্তির কারণে অনেক সময় সংসারের অভ্যন্তরে এক বিশেষ ধরণের টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। আমরা তখন সেই টানাপোড়েন থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাই। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, সমস্যা থেকে পালিয়ে কখনই তার সমাধান সম্ভব নয়। সমস্যা কে সামনাসামনি মোকাবিলা করার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত হতে হয়। কিন্তু আমরা অনেকেই কোনো বিপত্তির মোকাবিলা করতে ভয় পাই এবং নিজেকে দুর্বল মনে করি। এই ভয় থেকেই আমরা জীবনের অধিকাংশ নির্ণয় করে থাকি। পাশাপাশি বিপত্তি থেকে পলায়ন করার চেষ্টা করে থাকি। কিন্তু যদি ভয় ভীতি উপেক্ষা করে বিপত্তি মোকাবিলা করার জন্য মনকে প্রস্তুত করতে পারি, তাহলে সঠিক নির্ণয় করতে অবশ্যই সক্ষম হবো এবং মনের শক্তি বৃদ্ধি পাবে। যে রূপ ব্যায়াম করলে শরীরের অস্থি, মজ্জা পোক্ত হয় এবং শক্তি বৃদ্ধি পায় । এই প্রস্তুতির প্রথম শর্ত হলো ধৈর্য, আমাদের অনেকেরই যার বড্ড অভাব। কিন্তু কি সেই ধৈর্য? কি করেই বা তা অর্জন করা সম্ভব? সত্যি কথা বলতে বাইরে থেকে বল প্রয়োগ করে কখনই ধৈর্য উৎপন্ন করা সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার মানসিক স্থিতি। কিন্তু মানসিক স্থিতি তখনই সম্ভব যখন ব্যক্তির অধিকাংশ নির্ণয় ন্যায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেয়। কিন্তু এ নির্ণয় গ্রহণ করতে হৃদয়ের যে দৃঢ়তার দরকার হয় তা অর্জন করতে হলে দরকার সুশিক্ষার। এই শিক্ষাই তার সামনে নির্ণয়ের মার্গ নির্দেশ করে দেয় । এক্ষেত্রে যে শিক্ষার কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে সেটা কখনোই শুধু প্রথাগত শিক্ষা নয়। প্রথাগত শিক্ষা আপনাকে ডিগ্রি দেবে আর প্রকৃত শিক্ষা আপনার মনের সকল মাধূরির বিকাশ ঘটাবে, মানুষের মধ্যে অন্তর্নিহিত সমস্ত সম্ভাবনার প্রকাশ এবং প্রয়োগের সামর্থ্য জন্মাবে। এই শিক্ষা মানুষকে যেমন সমৃদ্ধ করবে, তেমনি সমস্ত বিপত্তির মুখোমুখি দাঁড়ানোর স্পর্ধার জন্ম দেবে।
সমগ্র সংসারেই পরিবার পরিজনের মধ্যে একটা বন্ধন কাজ করে। এই বন্ধন ছেড়ে যেতে যে কতখানি মন খারাপ লাগে, সেটা আজ পর্যন্ত কেউ সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করতে পারেন নি। কারণ এই কষ্টের কথা কারো সঙ্গে শেয়ার করার সে সময় তিনি পান না। এর প্রধান কারণ হলো তাঁর মনে যখন এই মহা কষ্ট পরিপূর্ণ রূপে অনুভূত হয়, সেই ক্ষণেই মহাকাল এসে হাজির হয়। এমনটাও বলার সময় নেই-” তুমি একটু দাঁড়াও, আমি একটু আপন জনের সঙ্গে এই খারাপ লাগাটা শেয়ার করে আসি “। এটা যেমন একটা সত্যি, তেমনি আরও একটা সত্যি রয়েছে- সেটা হলো আমরা যতক্ষণ জীবিত রয়েছি তার প্রতিটা ক্ষণই নির্নয়ের ক্ষণ। নির্ণয় করতে করতে সামনের দিকে এগিয়ে চলি। এই সমস্ত নির্ণয়ই ভবিষ্যত কে আধার করে গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু আমরা তো কেউ ভবিষ্যত জানি না। তাই সমস্ত নির্ণয় কখনও নির্ভুল হতেই পারে না। কিন্তু সমস্ত নির্ণয়ই যদি ন্যায় কে সামনে রেখে গ্রহণ করতে পারি তাহলে সেই নির্ণয় কখনও পীড়া দায়ক হতে পারে না। কিন্তু সাময়িক ভাবে মোহ আমাদেরকে এমন ভাবে গ্রাস করে যে, আমরা সেই সাময়িক স্বার্থের জন্য সীমাবদ্ধ গন্ডির বাইরে বের হতেই পারি না। ফলে সেই সময়ে মনের যে রূপ স্থিতি উৎপন্ন হয়, সেই রূপ পরিস্থিতিতে যে নির্ণয় করে থাকি তা ভবিষ্যতের জন্য অধিক পীড়াদায়ক হয় এবং জীবনে সুখ-শান্তির পরিবর্তে নেমে আসে অশান্তি। জগতের অধিকাংশ মানুষই চান নিজের ভবিষ্যত এবং তাঁদের সন্তানদের জীবনকে সুরক্ষিত করতে। এটা কোনো অপরাধ নয়। সমস্ত মানুষেরই অধিকার রয়েছে তাঁদের নিজের জীবন এবং তাঁর সন্তানদের ভবিষ্যত সুরক্ষিত করার এবং সুন্দর করে গড়ে তোলার । কিন্তু আমরা কখনও কখনও সুখ এবং স্বাচ্ছন্দ্যের পরিবর্তে নিজের অজান্তেই কাঁটা বৃক্ষই রোপণ করে থাকি। আবার সংসারের মধ্যে সেই দায় নিজে নিতে না চেয়ে অপরের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করে থাকি, যা সম্পূর্ণ রূপে অন্যায় । কখনও কখনও এমনটা আমাদের মনে হয় যে - সংসারের বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তান- পরিজন জীবিত না থাকলে হয়তো আমরাও বাঁচবো না। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে কি দেখি? অনেকের পরিজন চলে গেলেও দুদিন কান্নাকাটি করি কিন্তু আবার সব সামলে স্বাভাবিক ছন্দে চলার চেষ্টা করি। ঘটনা প্রবাহ প্রমাণ করে যে, আপনজন হারানোর পীড়া যত কঠিনই হোক না কেন- বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা সামলানো সম্ভব। না হলে পরিজন হারানোর পরেও সারা পৃথিবীতে এতো মানুষ জীবিত আছেন কি রূপে? তবে এটাও ঠিক- সংখ্যাটা খুব সামান্য হলেও এমন মানুষ আছেন, যাঁরা সত্যি সত্যিই পরিজনের চলে যাওয়ার যন্ত্রণা সহ্য করতে পারেন না, ফলে আঘাতের কারণে অনেকর মৃত্যুও হয়। এমন ঘটনা দেখে বুঝতে হবে যে এই সকল ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে পরিজন-রাই হলেন প্রিয়জন। তাহলে এটাই কি স্বাভাবিক নয়, যে পরিজন বিয়োগ সামলানো গেলেও প্রিয়জন বিয়োগ সামলানো প্রায় অসম্ভব। আমারা বাঁচতে চাই সম্পর্কের কারণে। কিন্তু কি সেই সম্পর্ক? স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালোবাসাই হলো সেই সম্পর্কের ভীত। কিন্তু এই ভীত গুলির সাথে করুণার কোনো সম্পর্ক সত্যিই কি আছে? নাকি আমাদের মনে যখন করুণা জন্ম নেয় তখন এই বন্ধন গুলি শিথিল হতে থাকে ? সে প্রশ্ন সমাজে আজও ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে- অপরের দুঃখ যেমন কারো মনের করুণার জন্ম দেয় তেমনি করুণা থেকেই অহংকারের জন্ম নেয়। যে অহংকার মানুষ এবং মনুষ্যত্বের মধ্যে প্রেম এবং প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে বিভেদের দেওয়াল তুলে দেয়। যার কারণে বহু প্রণয়ের সম্পর্ক মিলনের মালাতে পরিণত হতে পারে না। শুধু এই কারণের জন্য সমাজে বহু সংখ্যক মানুষ পীড়া ভোগ করে চলেছেন। এই নির্ণয় করতে গেলে সবার প্রথমে দরকার আমাদের হৃদয়কে সুশিক্ষিত করা। কিন্তু কি সেই শিক্ষা? প্রথাগত শিক্ষা ডিগ্রির কাগজের বোঝা ? যে বোঝা অর্জনের জন্য আজকাল মুখস্থ বিদ্যা পিষে মারছে মেধাকে! লক্ষ্মী অর্জনের জন্য সারা দুনিয়াতে মানুষ সরস্বতীর থেকে লক্ষ্মী কেই অধিক গুরুত্বপূর্ণ দেন! কিন্তু সরস্বতী এতোটাই শান্ত এবং উদার যে সে কখনোই লক্ষ্মীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জান না। এই কারণের জন্যই হয়তো একথা সমাজে একথা আজও প্রচলন রয়েছে যে - টাকাই শেষ কথা বলে না। মানুষই টাকাকে জন্ম দেয়- টাকা কখনই মানুষ কে জন্ম দেয় না।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct