ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর থেকে পশ্চিমা বিশ্ব সপ্রশংস দৃষ্টিতে দেখছে কীভাবে পুতিনের স্বৈরতান্ত্রিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের সাহসী জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। বাস্তব ক্ষেত্রে এই প্রশংসা অভূতপূর্ব মানবিক ও সামরিক সহায়তা হিসেবে হাজির হয়েছে, যেটা ছাড়া ইউক্রেনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো না। কিন্তু স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ যে বিষয়টি সামনে এসেছে সেটা হল, এই যুদ্ধ সমস্ত বিশ্বের যুদ্ধ। এ নিয়ে লিখেছেন ভ্যাসিল সেরেপানিন। আজ শেষ কিস্তি।
বিশ্বজনীন মানবাধিকার বোধের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা পশ্চিমা ধারণার সঙ্গে এখন পুতিনের রাশিয়ান-বিশ্ব ভাবনার সরাসরি লড়াই চলছে। পুতিনের ধারণাটির ভিত্তি স্বদেশিকতাবাদ। ক্রেমলিনের এই মতাদর্শ বিকৃত আয়নায় পশ্চিমা মতাদর্শের প্রতিচ্ছবি। এই চিন্তাকাঠামোতে সার্বিয়া থেকে কসাভোকে ন্যাটো যেভাবে স্বাধীন করেছিল, ক্রেমলিনও ক্রিমিয়াকে আত্তীকরণের ক্ষেত্রে সেটার সাদৃশ্য খোঁজে। একইভাবে জর্জিয়া ও দনোবাসে রাশিয়া তাদের অনুপ্রবেশকে ন্যায্যতা দেয় আমেরিকার নিজস্ব যুদ্ধগুলোর সঙ্গে তুলনা করে। ক্রেমলিন যে নিরাপত্তা চুক্তি সংস্থা চালু করেছে, সেটা স্পষ্টত ন্যাটোর আদলে গড়ে তোলা। কাজাখস্তানে সামাজিক অস্থিরতা শুরু হলে এই সংস্থার মাধ্যমে রাশিয়া সেখানে সেনা মোতায়েন করেছিল। এভাবেই পুতিনের শাসনামল পশ্চিমাদের উপহাস করছে। রাশিয়ার ঐতিহাসিক মহত্ত্ব আবার ফিরিয়ে আনার জন্য পুতিনের যে প্রচেষ্টা, সেটা সাবেক সোভিয়েত আমলেরও প্রতিচ্ছবি।মহান দেশপ্রেমের যুদ্ধ (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এ জন্য স্তালিনের নাম বিখ্যাত) ছিল একমাত্র মিথ, যেটা সোভিয়েত ইউনিয়নের ধসে পড়া বহু বছর ঠেকিয়ে রেখেছিল। বর্তমান রাশিয়ার রাজনীতিতে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছে অতীতের এই মিথই। সোভিয়েত জামানার নিপীড়ন ও নির্যাতন শিবিরকে উঞ্ছ রেখে ক্রেমলিন এখন তাদের শাসনের বৈধতা দিতে নতুন এক মতাদর্শিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছে। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ন্যায্যতা দিতে ক্রেমলিন নাৎসি মুক্তকরণ, নিরস্ত্রীকরণ, গণহত্যা প্রতিরোধ—এ রকম যেসব পরিভাষা ব্যবহার করেছে, সেগুলো সরাসরি সেই মিথ থেকেই গ্রহণ করা হয়েছে। এটাই পুতিনের শাসনামলের মূল সত্য। এখানে বৈপরীত্যময় বিষয়টি হচ্ছে, নাৎসিবাদকে পরাজিত করার ক্ষেত্রে যে পরিভাষা একসময় ব্যবহৃত হতো, রাশিয়া তাদের নিজেদের ফ্যাসিবাদী সামরিক স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের ন্যায্যতা দিতে সেই একই পরিভাষা ব্যবহার করছে। এটা কোনো দুর্ঘটনা নয় যে পুতিনের যুদ্ধ (ইউক্রেনের ক্ষেত্রে এ যুদ্ধ মহান দেশপ্রেমের যুদ্ধ) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনুকরণেই সংঘটিত হচ্ছে। কয়েক দশক ধরে এ ধরনের যুদ্ধপদ্ধতি বিশ্বে অনুপস্থিত ছিল।
ইউক্রেনের প্রতি পুতিনের যে ঘোর, সেটা তাঁর ফ্যাসিবাদী চরিত্রেরই বহিঃপ্রকাশ। ইউক্রেনের ইউরো-ময়দান বিপ্লবের পর থেকেই এটা প্রবলভাবে দেখা যাচ্ছে। ওই বিপ্লবে ইউক্রেনের তৎকালীন রুশপন্থী প্রেসিডেন্টের গদি উল্টে যায়। এটা ছিল পুতিনের জামানার জন্য একটি ঘোরতর দুঃস্বপ্ন। ইউরো-ময়দানের সেই প্রেতচ্ছায়া বারবার তাড়িত করেছে ক্রেমলিনকে। আর সেটাই নিজ দেশের বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন চালাতে এবং বেলারুশ, সিরিয়া ও কাজাখস্তানের শাসকদের ক্ষমতাচ্যুতি ঠেকাতে তাড়িত করেছে পুতিনকে। তিনি বারবার করে বলেছেন, ইউক্রেন ‘রাশিয়াবিরোধী’। এর মধ্য দিয়ে তিনি রাশিয়াকে ইউক্রেনবিরোধী এবং ইউরো-ময়দানবিরোধী বানিয়েছেন। পুতিনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাঁর রাজনৈতিক যেকোনো বিকল্পকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। ইউক্রেনের ঘটনা সেটারই সংক্ষিপ্ত রূপ। পুতিন প্রতি বিপ্লবের একজন আদর্শ দৃষ্টান্ত। রাশিয়ার এখনকার একটি মৌলিক সমস্যা হচ্ছে, ক্ষমতা পরিবর্তন করা যায়, এমন কোনো ব্যবস্থা তারা গড়ে তুলতে পারেনি। পুতিন সময়কে জয় করার অসম্ভব এক কাজে হাত দিয়েছেন। তিনি চিরকাল ধরে শাসন করে যেতে চান। হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান আন্ডারসনের রূপকথার গল্প ‘বরফ রানি’-এর সেই ছোট্ট বালক কাইয়ের মতো তিনি হতে চান। সেই বালকের হাতে এক টুকরা বরফ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সেটা দিয়ে কীভাবে ‘অনন্ত’ শব্দটি উচ্চারণ করতে হবে, সেটা সে জানত না। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর পুতিনের কাছে ইংরেজি বর্ণমালার ‘ডব্লিউ’, ‘এ’ ও ‘আর’ এই তিন বর্ণই ছিল। এখন আছে শুধু ‘জেড’। সর্বাত্মক বিশ্বযুদ্ধের কোনো আলামত এখনো দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু চলমান যুদ্ধ থেকে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ যে বিষয়টি এরই মধ্যে সামনে এসেছে সেটা হলো, এই যুদ্ধ সমস্ত বিশ্বের যুদ্ধ। ইংরেজি বর্ণমালার শেষ বর্ণ হলো জেড। একটা ফাঁপা প্রতীক, এরপর অনন্ত, কিছু নেই, আছে শূন্যতা।
(সমাপ্ত...)
(লেখক কিয়েভের ভিজ্যুয়াল কালচারাল রিসার্চ সেন্টারের প্রধান)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct