ভোরের স্বপ্ন
আবদুস সালাম
______________
কদিন থেকেই সাবির আলি ভোরবেলা একটা স্বপ্ন দেখছে। একটা টায়ার বোঝায় লরি চাকা পাংচার হয়ে রাস্তার মাঝে পড়ে আছে। এতো চাকা থাকা সত্ত্বেও, কোন চাকা তার কাজ লাগেনা। সাবির আলির বহন করে চলেছে আজীবন সংসারের ঘানি। কি করেনি সে সংসারের জন্য। অসুস্থ বাবা-মা একদিকে অন্যদিকে সংসারের হাল। ব্যবসা-বাণিজ্য দেখা। বাড়ির ভাইরা সব বিয়ে করে নিজে নিজের সংসার সাজাতে ব্যস্ত। যদিও তারা একই অন্নে প্রতিপালিত হচ্ছে। একই অন্নে থাকতে গেলে যে সামান্য ত্যাগ স্বীকার করতে হয় সেটুকু সম্বন্ধে তারা সবাই উদাসীন হয়ে পড়েছে। ব্যবসার কর্মচারীদেরও ছন্নছাড়া ভাব । আসে যায় বেতন পায়। এরই মাঝে ব্যবসার তহবিল থেকে কিছু কিছু টাকা তুলে নেয় ভায়েরা দরকার আছে বলে। না দিলে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিবে এই হুমকি দেয়। তারাও বাধ্য হয় দিতে। মাঝে মাঝে চলছে ঠোকাঠুকি। কেউ কারো কর্তৃত্ব মেনে নিতে পারছে না । সংসার বন্যার মতো তোড়ে ভেসে যাচ্ছে। সাবির আলি আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে যাতে সংসারটা নষ্ট না হয়ে যায়। গ্রামে এই পরিবারের একটা সুনাম আছে। এটা কিছুতেই নষ্ট হতে দিতে চাই না।
তখন পর্যন্ত সে বিয়ে করতে পারছে না। ইচ্ছে করলে সে বিয়ে করে নিতে পারতো। শিক্ষিত ,কর্মঠ এবং মাদ্রাসা বোর্ডের পরীক্ষাতে পাশ করে আছে বলে অনেক মেয়ের বাবা লোভনীয় অফার নিয়ে হাজির হচ্ছিল। বিয়ের বয়স ও হয়েছে। এদিকে বিবেক তাকে থামিয়ে দিচ্ছে। একটু থেমে যা। দেখনা, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। চাকরি টা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করনা বাবা । বাড়ির বড় ছেলে তো। বাবা-মায়ের সব দায়ভার তার কাঁধে। নিয়ে টেনে চলেছে সংসারে ঘানি। এই হাল ধরাটা অনেকেরই পছন্দ নয়। এনিয়ে তার প্রতি আক্রমণ শানিত হচ্ছে বারবার। কখনো আক্রমণ চলছে সরাসরি, কখনো বা আড়ালে-আবডালে। জলে-স্থলে- বায়ুতে যেন চলেছে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। এরই মাঝে সাবির আলী চাকরি পেয়ে যায় নাচনা হুসেনীয় হাই মাদ্রাসায়। ভাগ্যক্রমে স্কুলের দূরত্ব বাড়ি থেকে মাত্র এক থেকে দেড় কিলোমিটার। সংসারের সকল কাজকর্ম মিটিয়ে দিয়ে কোনরকমে দুটো হাতে মুখে গুঁজে হাজিরা দিতে ছুটে যাওয়া। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মহাসীন সাহেব এবং অন্য শিক্ষকগণ ও মাঝে মাঝে কথার খোঁচা দিতে তাকে ছাড়েনা। উপায়হীন ভাবে সব কথা, অপমান নীরবে হজম করে চলেছে সে। সবদিকে তাল দিতে দিতে কাহিল হয়ে পড়েছে। অতিরিক্ত অমানুষিক পরিশ্রম শরীর যেন নিতে পারছে না ।
করোনার দাপট তখন তুঙ্গে। আবার কাজ ও পিছু ছাড়ছে না। বিরাম নেই এতটুকু। এদিকে বাড়িতে মা বাবা করোনা রোগী। ভাগ্যিস স্কুল বন্ধ। সশরীরে স্কুলে যেতে হচ্ছে না বলে বাড়ির কাজে বেশি করে মন দিতে পারছে। বাবা-মায়ের দেখভাল বেশি করে করতে পারছে। অমানুষিক পরিশ্রম আর পরিবারের লোকের গঞ্জনায় মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে সে। বাবা-মা দুজনকে নার্সিংহোমে ভর্তি করলে তো বিশাল অঙ্কের টাকা জলাঞ্জলি দেওয়া। আর অতো টাকা পাবেই বা কোথা থেকে। লোক মুখে যা শুনছি একবার নার্সিং হোমে ভর্তি করলে কম করে লাখ খানেকের আগে কোনো গল্প নেই। তার মানে এখন দুজন মানে জুলাই টাকার শ্রাদ্ধ করা। চিকিৎসা তো ঘোড়ার সিং কিছুই হবে না। কেবল অক্সিজেন দিয়ে ফেলে রাখবে। ডাক্তারও নার্স দিদিমনিরা পলিথিন কাপড়ের পোশাক পড়ে দু-মিটার দূর থেকে ছুঁয়ে ও দেখবে না। কেবল জিজ্ঞেস করবে এখন কেমন আছেন? সাবিরের পরিচিত বন্ধু ডাক্তার হেদায়েত উল্লাহ সাহেব। এক সময় দুজনে মিশনে ছিল। হেদায়েতুল্লাহ ডাক্তার হয়ে যায় আর সাবির আলী স্কুলের মাস্টার। সাইন্স গ্রুপটা খুব ভালো ছিল না। হেদায়েত দু’বছর কোচিং করে মেডিকেলে ভর্তি হয়ে যায়।সাবির ইংলিশ অনার্স করে। মাদ্রাসা বোর্ডে পরীক্ষা দিয়ে এক চান্সে ধরে ফেলে। পেয়ে যায় কাছে । ডাক্তার হেদায়েতুল্লাহর পরামর্শ অনুযায়ী বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার এনে শুরু করলো চিকিৎসা।বাড়ির কোনো লোক ভয়ে কাছে এলোনা। পুরো সেবাযত্নের ভার তুলে নিলো নিজ হাতে। আলাদা করে রান্না-খাওয়া-শোওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। আস্তে আস্তে বাবা মা হয়ে উঠলেন সুস্থ হয়ে। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম আর করোনা ভাইরাসের জোড়া আক্রমণ সহ্য করতে পারলো না সাবির। আক্রান্ত হয়ে পড়লো। করোনা হয়েছে বলে কেউ কাছে এলোনা। এমনকি ওষুধ কিনে যে কেউ এনে দিবে তাও নেই। আশপাশে কেউ নেই। সবাই তার করুন অবস্থা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সাবির ভাবছে সেই ভোরের স্বপ্নটা। টায়ার বোঝায় লরিটার টায়ার পাংচার হয়েছে। এতো টায়ার আগলে আছে কিন্তু তার প্রয়োজনে কোন টায়ার কাজে আসছে না ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct