ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর থেকে পশ্চিমা বিশ্ব সপ্রশংস দৃষ্টিতে দেখছে কীভাবে পুতিনের স্বৈরতান্ত্রিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের সাহসী জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। বাস্তব ক্ষেত্রে এই প্রশংসা অভূতপূর্ব মানবিক ও সামরিক সহায়তা হিসেবে হাজির হয়েছে, যেটা ছাড়া ইউক্রেনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো না। কিন্তু স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ যে বিষয়টি সামনে এসেছে সেটা হল, এই যুদ্ধ সমস্ত বিশ্বের যুদ্ধ। এ নিয়ে লিখেছেন ভ্যাসিল সেরেপানিন। আজ প্রথম কিস্তি।
গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর থেকে পশ্চিমা বিশ্ব সপ্রশংস দৃষ্টিতে দেখছে কীভাবে পুতিনের স্বৈরতান্ত্রিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের সাহসী জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। বাস্তব ক্ষেত্রে এই প্রশংসা অভূতপূর্ব মানবিক ও সামরিক সহায়তা হিসেবে হাজির হয়েছে, যেটা ছাড়া ইউক্রেনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো না। এসব প্রশংসনীয় পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা নেতারা আবার ইউক্রেন বিষয়ে কী কী তাঁরা করবেন না, সে বিষয়গুলোও জানিয়ে দিয়েছেন। এর মধ্যে সরাসরি ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধ না করা, যুদ্ধবিমান না পাঠানো ও নো-ফ্লাই জোন ঘোষণা না করার মতো বিষয়গুলো রয়েছে। যুক্তিবাদী রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ফ্রান্সিস ফুকোয়ামা বিষয়টির ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, ইউক্রেনীয়রা যদি রাশিয়াকে নিজেদের শক্তিতে পরাজিত করতে পারে, তবে সেটা ভালো হয়। ন্যাটো তাদের আক্রমণ করেছে, সেই ব্যাখ্যা দেওয়া থেকে মস্কোকে তাতে বঞ্চিত করা যাবে। যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধির আশঙ্কা এবং রাশিয়ার পারমাণবিক হামলার হুমকির মুখে পশ্চিমারা মানবিক চেহারা নিয়ে হাজির হয়েছে। এ অবস্থান সামরিক পাল্টা আক্রমণ হানার ক্ষেত্রে ন্যাটোর প্রস্তুতির যে ঘাটতি, সেটারই বহিঃপ্রকাশ। এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটা সামনে আসে সেটা হলো, ন্যাটো কি সত্যি সত্যি তাদের প্রতি ইঞ্চি ভূমি রক্ষায় প্রস্তুত?
অতীতে পশ্চিমারা মানবিক কর্মকাণ্ডের জন্য সামরিক বাহিনী ব্যবহারের নজির দেখিয়েছে। ‘মানবিক সামরিকতন্ত্র’–এর এ ধরনের ঘটনার সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত ১৯৯৯ সালের কসভো যুদ্ধে ন্যাটোর আগ্রাসন। ২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আফগানিস্তান যুদ্ধ ও ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধও এর দৃষ্টান্ত। নৈতিক বিশ্বজনীনতাবোধের আলোকে এসব মানবিক আগ্রাসনকে ন্যায্যতা দেওয়া যায়। কিন্তু গত গ্রীষ্মে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শোচনীয় প্রত্যাহার এবং সেখানকার ক্ষমতায় তালেবানের ফিরে আসার ঘটনায় মনে হচ্ছে, ‘মানবিক সামরিকতন্ত্র’ ব্যর্থ হয়েছে। বলা যায়, সামরিকতন্ত্র থেকে মানবিকতার বিচ্ছেদ ঘটেছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁও দুই বছর আগে বিষয়টিকে বলেছিলেন ন্যাটো নিজের মস্তিষ্ক মৃত্যুর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে কোনো নীতিগত অবস্থান নেই ন্যাটোর। উদ্দেশ্য পূরণের ক্ষেত্রেও আছে সন্দেহের অবকাশ। ইউক্রেন আগ্রাসনের আগে পুতিন ভালো করেই বিষয়টিতে হিসাব-নিকাশ কষেছেন। সর্বোপরি, ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া যুদ্ধ ও পূর্ব দনোবাস অঞ্চলকে নিজেদের অঙ্গীভূত করার ঘটনা পশ্চিমাদের কৌশলগত অঙ্গীকারের যে শূন্যতা, সেটাই খোলাসা করে দিয়েছে। পশ্চিমাদের এই দশার প্রধান দিকটা হচ্ছে তারা এখন ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে। কোনো ঘটনার সামনে তারা থাকতে পারছে না, ঘটনা ঘটলে তারপর তারা কেবল প্রতিক্রিয়া জানাতে পারছে। এ বিষয়ে ইউক্রেনে একটি কৌতুক বেশ চালু হয়ে গেছে। সেটা হলো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন যতক্ষণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে, ততক্ষণে রাশিয়া ক্রিমিয়াকে নিয়ে নেবে। এখন ইউক্রেনীয়রা এই ভেবে বিস্মিত যে ‘পশ্চিমের লক্ষ্মণরেখা আসলে কোনটি? যখন তাদের পাল্টা আক্রমণ করার সময় তখন তারা কেন অপেক্ষা করছে এবং আলোচনা করে সময়ক্ষেপণ করছে?’ আমরা আমাদের দিক থেকে দেখতে পাচ্ছি, ইউক্রেনীয়দের জীবন বাঁচাতে কোনো চেষ্টাই করা হচ্ছে না। এই ধীরে চলো নীতির চরম মূল্য দিতে হচ্ছে বুছা, ইরপিন ও হস্টোমেলে। শত শত গণহত্যার ঘটনা সেখানে ঘটছে। আট বছর আগে পশ্চিমারা রাশিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ মাফ করে দিয়েছিল। কিন্তু এবার ইউক্রেন পশ্চিমকে একটা সত্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এখন ইউক্রেনের পতন মানে পশ্চিমাদের রাজনৈতিক মৃত্যু।
(লেখক কিয়েভের ভিজ্যুয়াল কালচারাল রিসার্চ সেন্টারের প্রধান)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct